পরিশিষ্ট

Màu nền
Font chữ
Font size
Chiều cao dòng

আমি আবার, আর একটা বার
লেখা #AbiarMaria

পরিশিষ্ট:

তরী জিসানের মাথায় নবরত্ন তেল দিয়ে দিচ্ছে নাক মুখ কুঁচকে। জিসান মাটিতে বসে পেছনে হেলে আছে আর তরী ওর ঘাড়ের কাছে বিছানায় দুই পা ভাঁজ করে বসেছে। জিসান সহজে তেল দেয় না, তবে মাঝে মাঝে মাথা ব্যথা করলে এই তেল লাগায়। তরী চুলে তেল মেখে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,
"এই তেলের গন্ধে নাকের বাঁশি উল্টে গেল! এইটা দেও কেন শুনি?"
জিসান আরাম করে চোখ বন্ধ অবস্থায় বলল,
"কি বলো না বলো তুমি? এইটার গন্ধ খারাপ নাকি?"
"এমন কোনো ভালোও না!"
"আসলে তোমার হেয়ার ওয়েলের সাথে পার্মানেন্ট শত্রুতা তো, এজন্য এমন লাগছে"
"উহ!"

তেল দিয়ে মাথা মাসাজ শেষে তরী উঠে গেল। ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে হাতে পারফিউমড স্যানিটাইজার মাখলো। জিসানের কাছে আসার সাথে সাথে খপ করে সে ওর হাত চেপে ধরে ঘ্রান নিল, তারপর চুমু খেলো। তরী বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
"কিসব তেল লাগাও, বিরক্ত লেগে যায়"
জিসান চোখে মুখে রোমান্স ফুটিয়ে বলল,
"চলো তোমার বিরক্তি দূর করে দেই!"
"উহ, ক্লান্ত লাগছে খুব। ঘুমাবো"
তরী যেতে চাইলে জিসান ওকে পেছন থেকে হালকাভাবে কোমর দুইহাতে পেঁচিয়ে ধরে।
"শুধু পালাই পালাই, না?"
"রাত কত হয়েছে দেখেছ? ঘড়ির দিকে একটু কষ্ট করে তাকাও!"
"রোমান্সের জন্য তো রাতই ভালো! রাত যত গভীর হবে, রোমান্স তত গভীর হবে। রাতের গভীরতার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়বে তোমার আমার অনুভূতির গভীরতা!"

তরী চাইলেও এখন ছুটতে পারবে না ওর বাহুডোর থেকে। গত পাঁচ মাসে এই মিশনে একবারের জন্যও সফল হতে পারে নি। একে তো ওর গায়ের জোর খুব, তার উপর নববিবাহিত দম্পতির মত সে তরীর সাথে লেগে থাকে। তরী বিরক্তি প্রকাশ করলেও খারাপ লাগে, তা বলবে না। বরং কোনো কোনো দিন যখন জিসান খুব ক্লান্ত থাকে আর বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে, সেদিন তরীর চিন্তা হয়। অজান্তে ওকে কষ্ট দিয়ে ফেললো না তো? তরী এক হাতে জিসানের গালে হাত রেখে বলল,
"চলো না ছাদে যাই?"
"এখন? এত রাতে? জ্বীন ধরবে!"
তরী হেসে ফেলল।
"তুমি থাকতেও?"
জিসান ওর ঘাড় থেকে মুখ তুললো।
"আমি কি জ্বীনের সাথে পারব নাকি?"
"না মানে, সব ছেলেদের পিটিয়ে ভাগিয়ে দিতে। এখন এইসব জ্বীনকে পিটাতে পারবে না?"
একগাল হেসে ও তরীর ঘাড়ে চুম্বন করে বলল,
"তোমার জন্য জ্বীনের বাদশা হতেও রাজী আমি! কিন্তু ছাদে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে না"
"তুমি কি সত্যিই ছাদে যাবে না?"
"উহু"
"আচ্ছা, তাহলে চিলেকোঠায় চলো?"
"উহু। ঐদিনের মত তন্দ্রা উঠে কান্নাকাটি লাগিয়ে দিলে ইজ্জত থাকবে না। আবার পুরো বাড়ি সজাগ হয়ে যাবে, আর আমার মা আমাকে দৌড়ানি দিবে!"

তরীর ভীষণ হাসি পেলো। একটু রোমান্সের জন্য জিসান ওকে বাচ্চারা ঘুমানোর পর চিলেকোঠায় নিয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর তন্দ্রার কান্নাকাটিতে নিচে হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। ওরা দুজন তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে ভীষণ লজ্জার মুখে পড়েছিল। জোছনা তক্ষুনি কিছু না বললেও ছেলেকে পরদিন সকালে বলেছেন,
"আক্কেল জ্ঞান কিছু নিয়ে চলিস। এত বড় হয়েও কি আক্কেল জ্ঞান গুলায়া খাওয়াতে হবে তোকে?"
কথায় আছে- সামাঝদার ক্যা কিয়ে ইশারা হি কাফি হ্যায়! জিসান ঐদিন থেকে রাতের বেলা বউ নিয়ে ছাদে যাওয়ার চিন্তা ছেড়ে দিয়েছে। বাচ্চার বাবা মায়ের এই বিড়ম্বনা তো নতুন কিছু না। তরী সেদিন অনেকে হেসেছে, আজও হাসি পাচ্ছে। কোনোমতে হাসি চাপা দিয়ে বলল,
"তাহলে ওদেরকে নিসাদের ঘরে দিয়ে আসি?"
"ধুর, কি বলো? নাহ থাক। আচ্ছা, বাহিরে যাওয়ার জন্য এত পীড়াপীড়ি করছ কেন?"
"রাতের বাতাসে গা ভাসাই না অনেকদিন, তাই আর কি"

জিসান ওর মুখের দিকে চেয়ে কি যেন ভাবলো, তারপর ওকে কোলে তুলে ফেলল। তরী আৎকে উঠল।
"এই, ছাড়ো! আমি পরে যাবো কিন্তু!"
"না, পড়বা না"
"আমার ওজন বেড়ে গেছে আগের চেয়ে!"
"কথা সত্যি!"
"তার মানে তোমার কাছে আমাকে মোটা লাগে?!"
"তুমিই তো বললা মাত্র!"
"আমি বললেই তোমার মানতে হবে? বলতে পারো না, না তরী, তুমি মোটা হওনি!"
"আমি মিথ্যা বলব কেন?"
"বউকে কমপ্লিমেন্ট তো দিতে পারো!"
"না, পারি না!"

কুটকুট করে তর্ক করতে করতে ওরা ছাদে চলে এলো। ছাদ জুড়ে একখন্ড আঁধার। আজ আকাশে চাঁদ নেই, তবে আশপাশ থেকে ছোটা আলো এসে ছাদের আঁধারের ঘনত্ব কমিয়ে দিয়েছে। তরী আর জিসান ছাদের দোলনায় এসে বসলো। একটা মৃদুমন্দ বাতাসে ওদের দুজনকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। জিসান  এক হাতে তরীর কাঁধ জড়িয়ে ওকে বুকে টেনে আনলো।
"আমার সেদিনের কথা মনে পড়ছে, জানো!"
"কোন দিন?"
"যেদিন তুমি প্রথম আমার কাছে এসেছ"
তরী লজ্জায় গুটিয়ে নেয় নিজেকে জিসানের বুকের মাঝে। কিছুটা অপেক্ষা করে জিসান ওর থুতনিতে ধরে মুখ উঁচু করল।
"একটা সত্যি কথা বলবে?"

আধো আলো আধো অন্ধকারে জিসানের চোখের ভাষা তরী পড়তে পারছে না। তবুও বললো,
"অকারণে মিথ্যা কেন বলব?"
"ইমরানকে মিস করো?"
তরী মুখ ঘুরিয়ে হাসলো। জিসান একটু ইতস্তত করছে।
"আসলে... অনেক দিন বলতে গিয়েও বলি না। মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে, তারপর মনে হয়, ওকে মিস তো করবাই। এটাই তো স্বাভাবিক"
তরী হাসলো।
"মিস করি না। আবার করিও!"

জিসান বেশ অবাক হলো।
"এটা আবার কেমন?"
"মিস না করার কারণ তুমি অনেকটা ওর মতোই। ওর কথা বলা, অভ্যাস, অনেক কিছু তোমার সাথে মিলে। মাঝে মাঝে মনে হয়, ও বেঁচে থাকলে এমনই করত। তুমি বাচ্চাদের খেয়াল রাখো, বাচ্চাদের দেখে রাখো, আমার খেয়াল রাখো। আমার মনে হয়, আমি ইমরানকেই আবার পেয়েছি। আবার ওর নিজস্ব কিছু ব্যাপার আছে। সেসব মিস করি মাঝে মাঝে"
"রাগ করে আছো এখনো ওর উপর?"
তরী মাথা নাড়লো।
"আমি ওর উপর রাগ করিনি, ওটা অভিমান। আমি চেয়েছিলাম আমাদের সম্পর্কে কোনো মিথ্যা থাকবে না। আমি জানতাম ও সবসময় আমাকে সত্য বলেছে। অথচ এখন ভাবলে ওর উপর ভীষণ  অভিমান হয়। আমার সেই এক্সিডেন্টের পর অনেক কৃতজ্ঞ থাকতাম ওর প্রতি। আমার মনে হতো, ও আমার লাইফ সেভিয়ার! আমি চোখ বুঁজে ওকে আমার পার্সোনাল এঞ্জেল ভাবতাম। অথচ ও না, বাঁচিয়েছ তুমি!"
"ইমরান কিন্তু কিছুই জানতো না। জানলে হয়ত..."
"সেটা বড় নয়। ও আমাকে পাওয়ার জন্য একটা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। তোমাকে আমার সামনে যেতে নিষেধ করেছে, জানাতে নিষেধ করেছে যেন আবার আমার তোমাকে পছন্দ না হয়। এটা কি একটা বড় অপরাধ নয়?"
"এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়্যার পরী!"
"তাই? তার মানে তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসো নি!"

তরী বুকের উপর হাত ভাঁজ করে চোখ কুঁচকে তাকায়।
"এটা তো ঠিক না! ভালোবাসবো না কেন?"
"ভালোবাসলে তো তোমারও 'এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়্যার' যুক্তিতে ভাইকে থামিয়ে দেয়ার কথা ছিল। এতদিনের সব কথা ভেঙে বলে আমাকে নিয়ে জীবন সাজানোর কথা! সেটা করলে না কেন?"

জিসান জবাব দিতে চাইলে তরী থামিয়ে দেয়।
"আমিই বলি কেন করোনি। কারণ তোমার কাছে আমাকে পাওয়ার চাইতে ইমরানের মনে আঘাত দেয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তুমি ভেবেছ, আমি তো কিছুই জানি না, তাই তুমি যদি সরে আসো, তোমার ভাই সুখে থাকবে। তুমি নিজে কষ্ট বরণ করে আমাকে ভাইয়ের জন্য সেক্রিফাইস করলে!"
"এরকম না আসলে..."
"এরকমই ব্যাপারটা! আচ্ছা, তুমি কি নিশ্চিত ছিলে তোমার ভাই আমাকে সুখে রাখবে?"
"ইমরান কি তোমাকে সুখে রাখেনি?"

তরী উঠে দাঁড়ালো। ছাদের রেলিঙের এক পাশে পিঠ ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকালো।
"তোমার ভাই আমাকে বড় অসুখে রাখেনি, তবে একেবারে সুখের চাদরেও মুড়িয়ে রাখেনি! ওর এত ভালোবাসা দেখে আমি নিজেকে অনেক সুখী ভাবতাম, বিয়ের পর কত সুখে থাকব, সেসব কল্পনা করে একা একা শিহরিত হতাম। এই ভুল কিছুটা ভাঙলো ইশতি পেটে আসার পর"
"মানে?! ইমরান তো তোমাকে অনেক ভালোবাসত"
"আই এগ্রি! অবশ্যই বাসতো, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ওর কিছু সমস্যা ছিল। প্রেগ্ন্যান্ট জানার পর ও খুশিই ছিল, কিন্তু আমার কাছ থেকে আগের মতই সার্ভিস চাইতো। এই যেমন পানি গরম করা, রান্না করে খাওয়ানো, ডিশ ওয়াশ মানে হাড়ি পাতিল ধোয়া, কাপড়ও ধুতাম"
"ও সাহায্য করত না?"
"সাহায্যের প্রয়োজন বোধ করত না, সুস্থ ছিলাম তুলনামূলক। তার উপর ও তখন চাকরি নিয়ে স্ট্রেসে থাকতো খুব। আমাকে ডেকে খাওয়াবে দূরে থাক, ওকে আমার খাওয়াতে হতো। ওর খেয়ালই আমি বেশি রেখেছি"
"মায়ের বাড়ি থাকোনি তখন?"
"ছিলাম তো, শেষের দিকে। তখন আর পারতাম না। ইমরান কিছুটা বুঝতে পারে তখন। ঐ সময় যত্ন করত খুব। কিন্তু শুরুর দিকে যখন ও রাগ দেখাতো, কয়েকদিন কথা বলত না, আমার মুড সুইং দেখে আরও রেগে যেত, তখন খুব কষ্ট পেতাম। মাফ করলেও পরে মাঝে মাঝে সেসব মনে পড়ত। হিউম্যান সাইকোলজি খুব অদ্ভুত। তারা তাদের কষ্টের সময় পাওয়া কষ্টগুলো সহজে ভুলে না। আমিও ভুলিনি। ঐ সময় অনেক স্ট্রাগল করেছি। সারাদিন একা একা থাকতাম। দিন শেষে ইমরানেরও সময় হতো না। উলটো রান্না কেন খারাপ হলো, পুরাতন খাবার কেন টেবিলে আসলো, মজা হলো না কেন, এসব অভিযোগে মাঝে মাঝে ঠিকভাবে খেতো না। অথচ একবারও ভাবতো না আমি যে রান্না করছি, এটাই তো বেশি! একদিন খুব মাথা ব্যথা ছিল। ওর পাশে শুয়ে শুয়ে কাঁদছিলাম। তিন দিন মাথা ব্যথা থেকে সেদিন তীব্র হয়েছিল, সহ্য হচ্ছিল না। ও আমাকে একবারও জিজ্ঞাসা করেনি কেন কাঁদছি! আমি ছটফট করতে করতে সেদিব আবিষ্কার করলাম, আসলে আমার কষ্টে সবসময় ওর আসে যায় না। আমার কষ্ট ওকে সেভাবে বিচলিত করে না যেভাবে ওর কষ্ট আমাকে বিচলিত করে। কি অদ্ভুত!"

জিসান বেশ অবাক হয়ে ওর পাশে এসে দাঁড়ালো।
"তুমি তো কখনো আমাকে এসব বলো নি!"
"তুমি কেন, কেউই জানেনা এসব। কি হবে বলে? ও তো শুধু কষ্ট দিয়েছে, এমন না। ভালোও বাসতো। আমি যা খেতে চাইতাম, ঘরে রাখার চেষ্টা করত। টাকার টানাটানি ছিল, কিন্তু আমাকে সেটা বুঝতে দিত না। আমি যখন ওর নামে একটা খারাপ কথা বলব কারো কাছে, তারপর আমি যতই প্রশংসা করি, ঐ মানুষটা কিন্তু ওকে খারাপই ভাববে। এজন্য বলিনি"
"এখন বলছ যে?"
"এটা বোঝানোর জন্য বললাম যে, তুমি আমাকে যতটা সুখী ভাবতে, সেটা তোমার ভুল ধারণা ছিল। আর সবার মতো তোমার ভাইয়ের মাঝেও অনেক খুঁত ছিল, আমাকে অনেক একা একা থাকতে হয়েছে। আমি আমার ক্যারিয়ার সেক্রিফাইস করেছি, রান্নাবান্না জীবনে না করলেও ওর জন্য সব রান্না শিখেছি, শুধু ওর জন্য! সে তুলনায় সে আমার জন্য কমই বদলেছে"

দুজন দুপাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কয়েক মিনিট নীরব থেকে জিসান মুখ খুললো,
"হয়ত তোমাকে সেদিন পেয়ে গেলে ইমরানের মত করতাম আমিও। মানুষ আসলে যা চায়, তা পেয়ে গেলে তার মূল্য তার কাছে ধীরে ধীরে কমে যায়। অথচ হারিয়ে গেলে মনে হয়, সে নিঃশ্বাস আটকে মারা যাবে!"
"বাদ দাও পুরাতন কথা। ভালো খারাপ, অনেক রকম চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এসেছি এই পর্যায়ে। জীবনে এসব থাকবেই। একশ ভাগ সুখী কেউ না"
একটু থেমে ও প্রশ্ন করল,
"তুমি এবার একটা সত্য বলো। এই কয় বছরে প্রেমে পড়োনি? কাউকে ভালো লাগে নি?"

জিসান হেসে ফেলল।
"আমি জানি, তোমার মত হ্যান্ডসাম ছেলে প্রেমে না পড়লেও তোমার উপর ফিদা হওয়া মেয়ের অভাব ছিল না! টেল মি টেল মি! আমি শুনতে চাই!"
তরী আগ্রহ নিয়ে হাসিমুখে জিসানের দিকে তাকিয়ে আছে। জিসান অস্বস্তিকর হাসি দিয়ে বলে,
"নিজের বউকে এসব বলা ঠিক কিনা জানি না, তবে  কিছু মনে করো না, হ্যাঁ? বিদেশে গিয়ে একটা মেয়ের সাথে লিভ টুগেদার এ ছিলাম আমি"

তরী কিছুক্ষণ অবিশ্বাস নিয়ে চেয়ে থেকে মুখ গম্ভীর করে ফেলল। ঠোঁটে ঠোঁট পিষে বলল,
"কি অসভ্য তুমি!"
তারপর এমন একটা চেহারা বানালো যেন বমি করে দেবে। জিসান ওকে এক হাতে টেনে এনে থুতনিতে ধরে মুখ উঁচু করল।
"বললাম আর বিশ্বাস করে নিলে?"
"বিশ্বাস করব না কেন? তুমিই তো বললে!"
জিসান ওর চোখে চোখে রেখে বলল,
"তুমি ছাড়া আর কারো প্রতি আকর্ষণ হয়নি জানো! তোমাকে হারানোর পর আমি সবসময় চেষ্টা করতাম নিজেকে ব্যস্ত রাখতে। ঐ সময় এমন দিনও গেছে যেদিন আমি মাত্র তিন ঘন্টা ঘুমিয়েছি। বিদেশে অবশ্য খারাপ লাগতো খুব। ওখানে একটা বাঙালী মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। মেয়েটা অনেক ইন্টারেস্টেড ছিল। আমি একবার ভেবেছিলাম ওর সাথে জীবন কাটিয়ে দিব কিনা। কারণ একা কত বছর থাকব? পাঁচ কিংবা দশ? এক সময় তো আমারও ঘরে ফিরে একটা মানুষ লাগবে। কিন্তু খেয়াল করলাম মেয়েটার ড্রিংকিং প্রব্লেম আছে। পাশাপাশি ছেলেদের সাথে বেশ ফ্রি মাইন্ডে মিশে। ওকে মন থেকে ছুড়ে ফেললাম। এরপর দেশে এসে তোমাকে বিয়ে করতে চাইলাম। তুমি তো স্বামী শোকে কাতর, তার উপর ভাসুরকে মানবা না। কেন তোমার ভাসুর হলাম, এজন্য নিজেকে অভিশাপ দিতে দিতে হানিকে বিয়ে করতে গেলাম। এরপর সব তো তুমিই জানো!"

"আচ্ছা, আমাকে কেন এত ভালোবাসো? আমি সুন্দরী বলে? আমার সৌন্দর্য দেখে?"
"নাহ, তেমনটা না। তোমার সৌন্দর্যে আকর্ষিত হয়েছিলাম ঠিক, কিন্তু তোমার প্রেমে পড়েছিলাম কেন সেটা আজও জানি না। হয়ত তুমি আমার জীবনসঙ্গী হবে বলে, হয়ত তোমাকে নিয়ে আমার ভবিষ্যতের জীবন সাজাবো বলে, আমার অস্তিত্বের একটা অংশ হবে বলে!"

দুজন দুজনের দিকে তন্ময় হয়ে চেয়ে আছে। জিসান তরীকে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো।
"ভালোবাসো?"
"জানি নাহ"
"ছয় মাসে জানতে পারলে না ভালোবাসো কিনা?"
"ইমরানের প্রেমে আমি আছাড় খেয়ে অন্ধভাবে পড়েছিলাম। ওর ভুল গুলোও আমার কাছে ভুল মনে হতো না। কিন্তু তোমার প্রেমে আমি সেভাবে পড়িনি। আসলে প্রেমে পড়েছি কিনা সেটাই জানি না এখনও। তোমার খারাপ দিক গুলো খারাপ লাগে, অন্ধবিশ্বাস নেই তোমার উপর, যখন তখন রোমান্সে ডুবার জন্য ছটফট করি না। কেমন যেন ম্যাচিউর একটা অনুভূতি! এটাকে কি ভালোবাসা বলে?"
জিসান গম্ভীর মুখে বলল,
"এটাকে বলে এডাল্ট প্রেম! এডাল্ট লাভ!"
"আশ্চর্য! এর আগে কি ওটা টিনেজ প্রেম ছিল নাকি?"
"হুম"
"কোনটা ভালো? এডাল্ট প্রেম? নাকি টেনেজ?"
"টিনএজ প্রেম। তাহলে অন্তত ভালোবাসি বলতে কিপ্টামি করতে না! তুমি তো আসলে আমাকে ভালোবাসো। কিন্তু সেটা স্বীকার করো না কেন? একবারও কি ভালোবাসি বলা যায় না?"

জিসান ওর ঘাড়ে, গালে মুখ ঘষতে শুরু করেছে। তরী দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে বলল,
"ভালোবাসি বললেই কি ভালোবাসা হয়? এই যে তোমার সাথে সংসার করছি, তোমার চুলে বাজে গন্ধওয়ালা তেল দিয়ে দিচ্ছি, তাতে চলে না?"
"চলে। কিন্তু তবুও শুনতে ইচ্ছা করে। তুমি যেমন নিজেকে সুন্দর লাগছে জানার পরও স্বামীর মুখ থেকে প্রশংসা শুনে নিশ্চিত হতে চাও, আমিও তোমার মুখ থেকে শুনে নিশ্চিত হতে চাই!"

তরী কিছুক্ষণ চুপচাপ জিসানের উষ্ণতা উপভোগ করে বলল,
"ভালোবাসি না। আই হেইট ইউ!"
জিসান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
"আরেকবার বলো তো!"
"আই হেইট ইউ!"
"আবার বলো?"
তরী হেসে ফেলল। জিসান ওর কোমরে চাপ দিয়ে বলল,
"খবর করে ছাড়ব কিন্তু আজকে!"
তরী ফিক করে হাসলো।
"কোন চ্যানেলে?"
"হুহ। তোমাকে শাস্তি দিতে পারব না বলে মজা নেয়া হচ্ছে?"

তরী নিঃশব্দে হাসছে। জিসান আবার কোমরে চাপ দিল।
"এই, চলো না বাবু নেই?"
তরী চোখ কপালে তুললো।
"তন্দ্রার দুই বছর হয়েছে এখনো? দুটোকেই তো মানুষ করতে পারি কিনা কে জানে, আবার আরেকটা? চাকরি থাকবে?"
"না করলে কি হয় চাকরি?"
"কিছুই হয় না। আমারও ইচ্ছা ছেড়ে দেয়ার। তুমি তো খেয়াল রাখোই। তাছাড়া চাকরি থাকলে তুমিও তো বলার সুযোগ পাচ্ছো না যে, সারাদিন বাসায় বসে বসে কি করো?!"
জিসান শব্দ করে হাসলো।
"এই কথা আমি কখনো বলবো না"
"ইমরান বলত মাঝে মাঝে, বিশেষ করে ঘরের কোনো কিছু অগোছালো পেলে, খাবার ভালো না হলে"
জিসান ওর কপালে গালে চুমু খেয়ে বললো,
"আমি বলব না। চাকরি ছাড়লেও তোমার টাকা লাগলে আমার কাছ থেকে নিয়ে নিবা, ভাবতে হবে না, শুধু জানালেই হবে। চাকরি ছাড়লে বাচ্চাদের বেশি সময় দিতে পারবা, অফিস থেকে ফিরে আমি ক্লান্ত থাকলেও তুমি আমাকে বেশি বেশি আদর করে ক্লান্তি দূর করতে পারবা!"
"অসভ্য! চুপ!"
"আহ! মাথা টিপে দেয়া, খেয়াল রাখা, সময় দেয়া, সেটা বুঝালাম! এত লজ্জা পাও কেন এখনো?"

তরী এক দৃষ্টিতে জিসানকে দেখছে। ইমরানও এসব বলত, কিন্তু কাজে প্রমাণ হতো না খুব একটা। জিসান পারবে, ও সত্যিই চেষ্টা করে তরীকে সব দিক থেকে ভালো রাখতে।
"কি দেখো?"
"তুমি এমন কেন?"
"কেমন?"
"বারবার তোমার প্রেমে পড়তে ইচ্ছা করে? খুব সচেতনভাবে প্রেমে পড়তে ইচ্ছা করে?"
"ভালোবাসো বলেই ইচ্ছা করে। শুধু স্বীকার করো না"

তরীকে নিয়ে জিসান নিচে নেমে আসলো। এত রাতে থাকা উচিত না ছাদে। বিছানায় শুয়ে তরীকে জড়িয়ে ধরলো। তরীও গুটিশুটি হয়ে ওর শরীরের সাথে মিশে থাকলো। শীতের শেষ দিক হলেও সিলেটে এখনো বেশ শীত পড়ে। এই সময় জড়াজড়ি করে ঘুমানোর চেয়ে আরাম আর কিছু নেই। জিসান ওর চুলে মুখ ডুবিয়ে আবার বলল,
"চলো না বাবু নেই?"
তরী মুখ তুলে ওর দিকে তাকালো"
"কি হয়েছে শুনি? দুই ছেলে মেয়ের যন্ত্রণা কি কম হয়ে গেছে?"
"এমন মধুর যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে আবার যেতে ইচ্ছা করছে"
"করবে না? ঝোল তো আমার ঝরবে, তোমার না!"

জিসান ওর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
"তুমি আমার কি, সেটা জানলে এ কথা বলতে না! জানো, আমার খুব ইচ্ছা আল্ট্রাতে বেবীর হার্টিবিট শুনবো, তোমার পেটে হাত রেখে বাবুর মুভমেন্ট খুঁজব, তোমার প্রেগ্ন্যাসি ক্রেভিং ফিলাপ করব, একটু একটু করে তোমার মাঝে আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন বেড়ে উঠতে দেখব আর তোমাকে আদরে আদরে ভরে রাখব!"

তরীর চোখে পানি চলে এসেছে। জিসানের বুকে মুখ লুকিয়ে বলল,
"এত ভালোবেসো না আমাকে! খুব ভয় লাগে। আরেকবার কাউকে হারাতে পারব না!"
"আমি হারাবো না পরী। আমি যে হারানোর জন্য আসিনি! হারানোর হলে তোমাকে আবার পেতাম?"

একটু পর আবার বলল ও,
"চলো না বাবু নেই?"

তরী বিরক্ত হয়ে উলটো ঘুরে গেল। জিসান একটু পর পর এক কথা বারবার বলে ওকে জ্বালাচ্ছে। যতক্ষণ না তরী খুব ক্ষেপে যাবে, ততক্ষণ ও এমনই করতে থাকবে। সকালে বলবে, ওসব তো মজা ছিল! তরী ভাবছে, কে বলবে ওদের জীবন অতীতে এত অদ্ভুত সব ঘটনায় পরিপূর্ণ ছিল? ওর সত্যি সত্যি আবার পুরো ভালোবাসা মেশানো প্রেমময় প্রেগ্ন্যাসি পিরিয়ড কাটাতে ইচ্ছে করছে। সিনেমায় যে দেখত স্বামীরা স্ত্রীকে আগলে রাখছে সারাক্ষণ, কেমন লাগে তখন ঐসব মেয়েদের?

জিসান ওকে সবসময় আগলে রাখে। গত মাসে সবাই মিলে সমুদ্র দেখতে গিয়েছিল। তখন জোয়ার চলছিল। তরী হুট করে ঢেউয়ের দোলায় পড়ে যাচ্ছিল, জিসান খপ করে ওর কোমর ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়। এরপর সারাক্ষণ ওকে দেখে দেখে রেখেছিল। এমনকি সামান্যতম অনুযোগের সুযোগও দেয়নি। কে জানত একটা বড় ধাক্কার পর এত ভালোবাসা ওর দ্বারে এসে কড়া নাড়বে?

এদিকে জিসান ওর কানের কাছে আস্তে আস্তে গান গাচ্ছে,
"আমি আবার, আর একটা বার বাবা ডাক শুনতে চাই!
আমি আবার, আর একটা বার তোমায় ভালোবাসতে চাই,
আমি আবার, আর একটা বার তোমার প্রেমে পড়তে চাই!"

....….....….....….....
•••••শুভ সমাপ্তি•••••

Bạn đang đọc truyện trên: Truyen2U.Pro