২৬

Màu nền
Font chữ
Font size
Chiều cao dòng

আমি আবার, আর একটা বার
লেখা #AbiarMaria

২৬

সকালে ঘুম ভেঙেও জিসানকে ঘরে না দেখে তরীর কিছুটা চিন্তা হলো। হাত মুখ ধুয়ে দেখলো জিসান চিলেকোঠার ঘরে ঘুমিয়ে আছে। তরী ধীর পায়ে দরজা খুলে সেখানে প্রবেশ করল। জিসান উলটো ঘুরে শুয়ে আছে, বোধহয় ঘুমিয়ে আছে। তরী কয়েক সেকেন্ড ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো, তবে স্পর্শ করে ডেকে দিতে সংকোচ হচ্ছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল ঘরের এক কোণায় অনেক গুলো সিগারেটের ফিল্টার পড়ে আছে, সংখ্যায় বারোটার মত হবে। জিসান কি এক রাতে সবগুলো খেয়েছে? এত স্মোক কেন করছে? টেবিলের উপর ডায়রি পড়ে আছে। তরী ডায়রি হাতে তুলে নিল। সেখানে লিখা-

ইমরান আর তরী জুটি হিসেবে পার্ফেক্ট ছিল। কিন্তু তার মানে এই না যে আমার আর তরীর জুটিও পার্ফেক্ট হবে না৷ বরং সেদিন আমার এক বন্ধু বলল, আমাদের চারজনকে দেখলে কেউ বলবে না ওরা আমার ভাইয়ের ছেলে মেয়ে। তরীও আমাকে পেয়ে সুখীই হবে। আসলেই কি তরী সুখী? আমি সুখী? মাত্র এক সপ্তাহ পার হলো। মানুষ তো জীবনের অর্ধশত বসন্ত পার করেও বলতে পারে না তারা সুখী কিনা। অথচ আমি এক সপ্তাহের মাঝে সুখ তালাশ করছি! সত্যিই, আমি পারিও। তবু জানতে ইচ্ছা হচ্ছে, ইমরান মরে গিয়ে আমার হাতে যে সুখের চাবি দিয়ে গেছে, আমি কি সত্যিই সেই সুখের বাক্স খুলতে পেরেছি? ইমরান না থাকাতে আমার জন্য সহজ হলো তরীকে পাওয়া। আজকে ও থাকলে অবশ্য গল্পটা অন্য রকম হতো!

এইটুকু পড়ার পর তরীর হাত কাঁপতে কাঁপতে ডায়রি পড়ে গেল। ওর মনে হলো, জিসান কি কিছু করেছে ইমরানকে? ইমরানের মৃত্যুটা কি স্বাভাবিক ছিল না? জিসান কি তরীকে পাওয়ার জন্য...

ডায়রি হাত থেকে পড়ে যাওয়ার শব্দে জিসান উঠে বসেছে। তরীকে এই ঘরে আর ডায়রি নিচে পড়ে থাকতে দেখে ও ভীষণ রেগে গেল।
"তুমি আমার ডায়রি ধরেছ কোন সাহসে?! তোমাকে না আমি প্রথম দিনই নিষেধ করে দিয়েছি এখানে আসার জন্য?!"
তরীর ঠোঁট কাঁপছে। জিসান বিছানা ছেড়ে উঠে আসলো, চেহারা আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে।
"তুমি অতিরিক্ত সাহস দেখাচ্ছো কেন আমার সাথে, হ্যাঁ?! কি?! এখানে এসে আমার ব্যক্তিগত স্পেস ভায়োলেট করার মানে কি!"

চিৎকার দিল জিসান। তরী কেঁপে উঠে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। জিসানও ওর দিকে এগিয়ে এসেছে, মুখ চোখ লাল। তরীর চোখ টলমল করছে। ও কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
"আপনি এসব কি লিখেছেন ডায়রিতে? আপনি ইমরানের মৃত্যুতে খুশি হয়েছেন, না? ওর মৃত্যুর আগে থেকেই আমার প্রতি আপনার কুনজর ছিল, তাই না? আপনি মিথ্যা বলেছেন আমাকে, ছিঃ! আবার ওকে আপনি মারেন নি তো?"

জিসান টেবিল থেকে গ্লাস নিয়ে আছাড় মেরে মুহুর্তে তা টুকরো টুকরো করে সারাঘরে ছড়িয়ে দিল। তারপর আরও হিংস্র হয়ে বলল,
"স্টুপিড মেয়ে কোথাকার! মাথায় কি তোমার গোবর নাকি? ইমরানকে আমি কিভাবে মারব? ও তো মারা গেল হাসপাতালের বেডে, তাও আবার তোমার হাতের উপর! তাও আবার সিম্পল জ্বরে! আর আমাকে দোষ দাও?! ইমরান কে ছিল জানো? ও আমার ভাই! আমার আদরের ছোট ভাই! কয় বছর ধরে তুমি ওকে চিনো? ওর জন্ম থেকে আমি ওকে চিনি!"

তরী জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। জিসান আবার চেঁচিয়ে উঠল,
"তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছ তরী! একে তো আমার ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দিয়েছ, তার উপর আবার এত বড় একটা ফালতু কথা বলেছ! বের হও এখান থেকে তুমি, বের হও!"

তরী এক ছুটে সেখান থেকে বেরিয়ে আসলো। নিচে নেমে জোছনার মুখে পড়ার আগেই ঘরে গিয়ে দরজা আটকে কেঁদে ফেলল। ইমরানের মৃত্যুর সময় দুঃখজনক ভাবে একমাত্র ওই পাশে ছিল। তবুও কেন জিসানের ডায়রি পড়ে ও এসব বলল? তরী কান্না মুছে নিজেকে বলল,
"আমি জানতাম আমার উপর তার অনেক আগে থেকেই নজর। সে সবসময় হয়ত ইমরানের মৃত্যুই চাইতো। নিজের ভাইয়ের বউয়ের দিকে মানু্ষ কিভাবে নজর দেয়! অবশ্য হতেই পারে, দেবর, ভাসুর, যাইই হোক, পুরুষ তো পুরুষই!"

ওদিকে জিসান রেগে গিয়ে ভেঙে ফেলা গ্লাসের টুকরো পরিষ্কার করতে করতে ভাবছে, কি দরকার ছিল এত রেগে যাওয়ার? ঘুম ভেঙে মাথার তার ছিঁড়ে গেছে তরীকে ডায়রি ধরতে দেখে। আসলে মানুষকে যা করতে নিষেধ করা হয়, সে তাইই করে সবসময়। এখন যে রাগ দেখিয়ে ফেলল, এর কি হবে? তরী এমনিতেই ওর থেকে কিছুটা দূরত্বে থাকে। যতটুকুই দূরত্ব ঘুচেছিল, আবার এখন সেটা নতুন করে বাড়বে! রাগ হয়ে ডায়রিটা নিয়ে সেটায় আগুন ধরিয়ে দিল। যত দোষ, সব এই ডাইরির! একটা কথা বলার মানুষ নেই বলে আজ ডায়রির সাথে বকবক করত। কে জানত ডায়রিও যে সব কথা বলে দেয়? তাও আবার বেযায়গায়? ডায়রির পোড়া শেষ হতে না হতেই জিসানের হুঁশ আসলো, তরীকে বোঝাতে হবে। এভাবে ভুল ভেবে বসে থাকলে সামনে আরও বড় সমস্যা দাঁড়াবে। সবকিছু হারালেও তরীকে ও হারাতে পারবে না।

ত্রস্ত পায়ে নিচে নেমে নিজের ঘরের সামনে এসে দেখল দরজা আটকানো। জিসান কয়েকবার ধাক্কানোর পরও তরী কোনো সাড়া দিচ্ছে না। কোন সমস্যা করেনি তো ও? জিসানের মনে সব আজেবাজে ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। ওর পেছনে এসে জোছনা দাঁড়ালেন।
"কিরে? তরী দরজা আটকে রাখছে কেন?"
তখনই তরী দরজা খুলে দাঁড়ালো।
"মা, টয়লেটে ছিলাম"
"টয়লেটে ছিলা তো টয়লেটের দরজাই না আটকাবা, ঘরের দরজা আটকাও কেন?"
তরীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জিসান বলল,
"আম্মু, তুমি যাও তো। অফিসে দেরী হয়ে যাচ্ছে। টেবিলে নাস্তা দিতে বলো"

জিসান ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। তরী কিছুটা সরে অন্য দিকে দাঁড়ালো। জিসান ওর হাত ধরে নিজের দিকে ঘোরালো।
"সরি তখন এভাবে চিৎকার করে উঠায়। আমার ঐ ঘরে তোমাকে যেতে মানা করার পরও গেছো, এজন্য আসলে ঘুম ভেঙেই রাগ উঠে গিয়েছিল। সরি"
"আমি জানি আপনি কেন আমাকে ওখানে যেতে নিষেধ করেছেন। আপনি কখনো চাননি আপনার আসল রূপ আমি দেখি"
"আমার আসল রূপ মানে?"
"মানে সিম্পল! আপনি সবসময় চেয়েছেন আমাকে। আপনি আপনার ভাইয়েত বউয়ের দিকে নজর দিয়েছেন! আপনি খুশি হয়েছেন যে আপনার ভাই মরে গেছে!"
"দেখো তরী, ফালতু কথা বলবা না আমার সাথে। আমার ভাই মরে গেলে আমি খুশি হবো কেন? শুধু তোমাকে বিয়ে করার জন্য?! এত বছরে আমাকে এত ন্যারো মাইন্ডেড মনে হলো তোমার কাছে?"
"আমি কি করব? আপনার ডায়রিতেই তো এসব লেখেছেন! ইমরান মরে গিয়ে ভালো হয়েছে!"
"মিথ্যা বলবা না তরী! আমি লিখেছিলাম, ইমরান মারা যাওয়ায় তোমাকে পাওয়া সহজ হয়েছে!"
"একই কথা!"
"মোটেও এক না!"
"তাহলে বলেন, ঠিক কবে থেকে আমাকে পছন্দ করেন আপনি? আমি নিশ্চিত, অনেক আগে থেকে! কিন্তু কেন? একটা বিবাহিত মেয়েকে পছন্দ করতে আপনার বাঁধলো না?"
"তরী, লেট মি গেট দিস স্ট্রেইট। আমি মোটেও আমার ভাইয়ের স্ত্রীর দিকে বাজে নজর দেইনি, ভুল করেও একবারের জন্যও না! আগেও বলেছি তোমাকে। এরপরও কেন বারবার এক কথা বলো?!"
"তাহলে বলেন, ঠিক কবে থেকে আমাকে পছন্দ করেন?"

জিসান কাউচে বসে মাথা টিপে ধরল। চোখ বুঁজে বলল,
"ইমরান মারা যাওয়ার পর। তখন থেকে আমার তোমাকে ভালো লাগে। তুমি, আমার ভাইয়ের এতিম বাচ্চাদের প্রতি আমি মায়ায় পড়ে গিয়েছি। তখন তো আর সেসব বলার উপযুক্ত সময় ছিল না, তাই প্রকাশ করিনি। জানি তুমি আমাকে পছন্দ করো না, কিন্তু আমি করি। তাছাড়া আমার ভাই তোমাকে একটা অসহায় অবস্থায় ফেলে গেছে। আমি চাচ্ছিলাম দ্রুত সেটার সমাপ্তি হোক। বাসাতেও সবাই বিয়ের কথা বলছিল, ওদিকে তোমার প্রতি দিন দিন দুর্বল হচ্ছিলাম। সব মিলিয়েই আর কি..."

তরী ওর পাশে বসল। নিচু কন্ঠে বলল,
"তাহলে ইমরান চলে যাওয়ায় আমাকে পাওয়া সহজ হলো- এর মানে কি?"
"এর মানে হচ্ছে যদি ইমরান বেঁচে থাকা অবস্থায় তোমার প্রতি আমার এমন অনুভূতির জন্ম নিত, তাহলে তোমার প্রতি আমার আকর্ষণ কাজ করলেও কখনো তোমার প্রতি আগাতে পারতাম না। ইমরান নেই, তাই এগিয়েছি"

তরী চুপ করে বসে আছে ওর পাশে। ওর কি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা উচিত, তা বুঝে উঠতে পারছে না। জিসান ওর ডান হাত চেপে ধরল।
"আমি সরি তখন এভাবে রিএক্ট করায়। ইমরানকে আমি সবসময় অনেক ভালোবাসতাম। ওর জন্য আমার সব বিসর্জন দিতেও আমি রাজী ছিলাম। তারপরও ওকে আমি কিভাবে মারব, এই কথাটা বলার আগে তোমার ভাবা উচিত ছিল। আমার তোমার প্রতি অনুভূতিতে কোনো খাদ নেই। কিন্তু তার মানে এই না যে এজন্য আমি এত নিচে নেমে যাবো! এখন থেকে কিছু বলার আগে একটু ভেবে চিন্তে বলো"
"আমিও সরি। আসলে আপনার ডায়রি পড়ে এরকম একটা চিন্তা মাথায় ঢুকে গিয়েছিল"
"এজন্যই প্রতিটা মানুষের নিজস্ব স্পেস ম্যান্টেইন করা উচিত। যখন আমি তোমার সব ব্যাপারে নাক গলাবো, কিংবা জানার চেষ্টা করব, তখন আমিও তোমাকে ভুল বোঝা শুরু করব। এটাই স্বাভাবিক"

তরী মনে মনে ভাবছে, আর জীবনেও জিসানের কোনো ডায়রিতে হাত দিবে না। জিসান তো ওর কাছে সব বলে দিল, কি দরকার ছিল ডায়রি ধরে শুধু শুধু ঝামেলা তৈরির?

জিসান তরীর হাত খানা মুঠো করে ধরে তাতে মুখ নামালো। দুহাতে ওর ডান হাত চেপে ধরে তরীর মুখের দিকে চেয়ে আছে। ওর চোখে চোখ পড়তেই তরী চোখ সরিয়ে নিল। ও একটু একটু করে জিসানের মাঝে যে ডুবে যাচ্ছে, সেটা জিসানের চোখের দিকে তাকালে অনুভব করে। জিসান বোধহয় জাদু জানে, কেমন করে যেন ওকে একটু একটু করে দখল করে ফেলছে। বেশ নরম স্বরে সে বলল,

"তরী?"
"হুম?"
"আমার সাথে থেকে তুমি সুখী?"
তরী কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে বলল,
"জানি না। তবে অসুখী না। আপনি অনেক ভালো একজন মানুষ। আপনি যে কোনো মেয়েকে সুখী করতে পারবেন"
"তার মানে তুমি সুখী। ভালোবাসো আমায়?"
"ঠিক জানি না। ভালোবাসার জন্য এক সপ্তাহ সময়টা খুব কম"
"এর আগে তাহলে কি ভেবে আমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছ?"
"অনেক কিছুই ভেবেছি। কিন্তু ভালোবাসার ব্যাপারটা আসলে..."
"লজ্জা পাচ্ছো?"
"নাহ, লজ্জা না। তবে আপনি আমার অভ্যাসে পরিণত হচ্ছেন। যখন আপনি বাচ্চাদের সাথে সময় কাটান, আমি তন্ময় হয়ে আপনাকে দেখি। খাবারের টেবিলে আপনার খাবারের দিকে বারবার তাকাই, খাবারের আইটেম এগিয়ে দেই। রাতে ঘুমানের সময় আপনি ঘরে না থাকলে আমার অস্বস্তি হয়। অফিসে যাওয়ার আগে প্রতিদিন আপনাকে সালাম দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যাওয়াটা আমার কাছে এখন স্বাভাবিক। এত অল্প সময়ে কিভাবে আমি আপনার প্রতি অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি জানি না। তবে ঐ যে বললাম, ভালোবাসার ব্যাপারটা এখনো বুঝতে পারছি না"

জিসান এবার কাউচে হেলান দিয়ে ওকে বুকে টেনে নিল। কপালে গাঢ় ভাবে স্পর্শ এঁকে দিতে দিতে বলল,
"আমাকে ভালোবাসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব। আশা করি আমার অপেক্ষার প্রহর খুব বেশি লম্বা হবে না!"

চলবে...

Bạn đang đọc truyện trên: Truyen2U.Pro