৩২

Màu nền
Font chữ
Font size
Chiều cao dòng


সকালে ঘুম ভেঙেও তরীর মন খারাপ। আচ্ছা, জিসানও কি ওর মত মাঝে মাঝে পুরাতন ভালোবাসার এলবাম নিয়ে বসে? ওকে না ভেবে পুরাতন ভালোবাসায় ডুবে? তরী বিছানায় হাঁটু উঁচু করে দুই হাতে পা জড়িয়ে ধরে তাতে মুখ গুঁজে বসে আছে। জিসান ঘরে এসে প্রশ্ন করল,
"এভাবে বসে আছো যে? অফিসে যাবেনা?"
"না, শরীর ভালো লাগছে না"
"কেন? কি হলো আবার?"
"কিছু না"
"তাহলে অফিস কামাই দিচ্ছো যে?"
"এত বেশি প্রশ্ন করেন কেন আপনি? না জানলে হয় না নাকি?"
তরী উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল হনহনিয়ে। জিসান অবাক হয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
"মেয়েটি অমন রেগে গেল কেন?"

তরীর বাচ্চাদের দিকেও আজ মনোযোগ আসছে না, কেবল অনুভব হচ্ছে, ওকে ডায়রির বাকি অংশগুলোও পড়তে হবে। অথচ একটা ছেলেমানুষী অভিমানও কাজ করছে। কি হবে পড়ে? পীড়াদায়ক সময় কাটাবে কি করে যখন জানবে জিসানের মনের গহীনে অন্য কারো বাস? তরীর মন খুব খারাপ হয়ে যায়। হুট করে ঘরে গিয়ে তৈরি হয়ে নেয়। জিসান অবাক হলো।
"তুমি না বলেছিলে শরীর খারাপ লাগছে, অফিসে যাবে না?"
"মত পালটেছি"
"শরীর ভালো লাগছে?"
"হ্যাঁ"
"মুখ দেখে তো তা মনে হচ্ছে না"
"তাহলে কি মনে হচ্ছে? আপনি বুঝি এখন মানুষের মুখও পড়তে পারেন?"
জিসান নিষ্পাপ হাসি হাসলো। তরীর গলা জড়িয়ে ধরে সে নিজের কাছে টেনে আনলো।
"অমন গাল ফুলিয়ে অফিসে যাবে নাকি? এমনিতেই রসগোল্লার মত ফোলা ফোলা গাল তোমার। তার উপর যদি ফুলিয়ে রাখো..."
তরী একটুও না হেসে জিসানের চোখের দিকে সরাসরি তাকালো। জিসান ওর গালের দিকে মুখ এগিয়ে আনতেই তরী সরে গেল।
"শুধু শুধু ঢং করবেন না, অফিসে দেরী হচ্ছে"
জিসান হতাশা মাখা কন্ঠে স্বগতোক্তি করল,
"মেয়েদের ভালোবাসলে অভিযোগ করে, আবার বাসলেও বিপদ!"
"আচ্ছা, আপনার খারাপ লাগে না আমার মত খারাপ মেয়ের পেছনে নিজের সব গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করছেন বলে?"
জিসান অবাক।
"খারাপ মেয়ে মানে?"
"এই যে, আপনি আমাকে এত পছন্দ করেন, অথচ আমাকে নিজের করে পাচ্ছেন না, আমি পুরোপুরিভাবে এখনো স্বামীর অধিকার বুঝিয়ে দেইনি আপনাকে। রাগ হয় না আমার উপর?"
"যদি আমার এমন কোনো ইচ্ছা হতো, এতদিনে কম সুযোগ পাই নি। এমন বেশ কয়েক রাত গেছে যখন চাইলেই আমার চাহিদা পূর্ণ করতে পারতাম। আমি করিনি। আমি চাই, তুমি নিজে আমার কাছে আসো, আমি যাবো না। আমি চাই, তুমি নিজে সম্মতিতে আমাকে তীব্রভাবে ভালোবাসবে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা ভালোবাসার মাঝে পূর্ণতা পায় তরী, কেবল বিছানার সম্পর্কটাই সব নয়। আর আমার কাছে তো নয়ই! আমাকে এতটা অধৈর্যশীল না ভাবলেও চলবে। তুমি একবার এই তীব্র প্রেমের স্বাদ পেয়েছ, আমি পাই নি। আমি চাই না এ থেকে বঞ্চিত হতে। তাই ধৈর্য্য ধরছি"
জিসান বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তরী বিড়বিড় করে ভেংচি কেটে বলল,
"যতই ভালো মানুষ সাজুন, ধৈর্যের গল্প শোনান, আমি জানি, নিশ্চিত ঐ মেয়েকে এখনো ভুলতে পারেননি বলেই এমন রিজার্ভ থাকেন। আমি বুঝি সব"

অফিসে গিয়েও তরীর অফিসের কাজে মন বসছে না। অগত্যা দুপুরের দিকে শরীর খারাপের কথা বলে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে এলো। কিছুদিন আগে একটা পার্ক আবিষ্কার করেছে, ওখানে বাঁধানো পুকুর ঘাট আছে। তরী পা দুলিয়ে সেখানে বসে ব্যাগ থেকে ডায়রিটা বের করে। ঐ পৃষ্ঠার পর থেকে আবার পড়তে শুরু করে।

"আমার পরীর দিকে হাত আর পা বাড়ানোর অপরাধে আজ দুজনের হাত পা ভেঙে দিয়েছি। ভাঙেনি বোধহয় আসলে, মচেকেছে কেবল। ওদের চিৎকার শুনে অবশ্য সেটা বোঝার উপায় নেই। এমন ভাবে চেঁচাচ্ছিল যেন এ জনমে আর বাঁচবে না! আমার হাসি পেয়েছে খুব৷ কিন্তু হাসা যাবে না। হাসলে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টিকারী বড় ভাই হওয়া যায় না। আমি বরং সিগারেট ফুঁকে ফুঁকে ওদের ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। আমার পরী আমার, সবসময় আমার থাকবে"

"এ পর্যন্ত আটটা ছেলেকে পিটিয়েছি। গতকাল আরেকটা ছেলেকে পিটাতে চেয়েছিলাম। এতদিন একবারও সুযোগ পাচ্ছিলাম না, ঐ ছেলে পরীর সাথে লেপটে থাকে। পরী ঐ ছেলের মাঝে কি পেয়েছে? কোন মধু? ছেলে তো ওর ক্লাসমেট। কি আছে এই পুচকা ছেলের কাছে? গতকাল একা পেয়ে কলার চেপে ধরেছিলাম। পরে জানালো, ও নাকি ভালো বন্ধু কেবল, অন্য কিছু না। আমার পরীকে পড়ালেখায় সাহায্য করে। ওকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছি, ফ্রেন্ডজোনের বাইরে যেন ভুলেও না বের হয়। বন্ধু ব্যতীত কিছু হলে তবে হাড়ের গিট এক এক করে ভাঙা হবে! ছেলে বড়ই ভীতু। পরীকে ভালো লাগলেও আগানোর সাহস পাবে না!"

"আজ আমার পরী শাড়ি পরে বেরিয়েছিল। পহেলা ফাগুন পালন করতে সে আজ আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে পা রেখেছে। আমার জীবনের এই পর্যায়ে এরচেয়ে মধুময় সময় বুঝি আর কখনো আসেনি! আমিও আজ কমলা রঙের পাঞ্জাবি গায়ে এসেছিলাম। আমার বন্ধুরা এই আট মাসে আমার পাগলামি টের পেয়ে গেছে। হ্যাঁ, ওকে দূর থেকে ভালোবাসার আট মাস হয়ে গেছে। আমার পরীটা আমার চোখের সামনে একটু একটু করে বড় হচ্ছে। আজ শাড়িতে দেখে হুট করে মনে হলো একদিনেই ও বড় হয়ে গেছে, আমার নিপাপুর মত! ওর কাছে গিয়ে কপালের চুল গুলো সরিয়ে তাতে চুমু খেতে ইচ্ছা করছে। একটা মানুষের এত সুন্দর হওয়া কি জরুরী? ও ওর বন্ধু বান্ধবীদের সাথে আনন্দ করেছে, ঘুরে বেড়িয়েছে। আমি কেবল দূর থেকে ওকে দেখে গেছি। আমার বন্ধুরা অনেক বার বলেছে ওর কাছে গিয়ে মনের কথা বলার জন্য। একটা ইন্টার পড়ুয়া মেয়ে কি এই বুকের উথাল-পাথাল সমুদ্রের গর্জন অনুভব করতে পারবে? কি ভয়াবহ প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে এই ছেলেটা, সেটা কি ও বুঝবে? যদি আমাকে ফিরিয়ে দেয়? যদি আমার সব স্বপ্ন শেষ করে দেয়? অনেক মেয়েকে দেখেছি ছেলেদের এমন অবস্থা দেখে আরও বেশি করে কষ্ট দেয়। আমি তা সইতে পারব না, এরচেয়ে দূর থেকে দেখে যাই। সময় হোক, আমিই একদিন বলব"

"আমার পরীকে আজ ওর বাসার বাইরে থেকে এক ঝলক দেখে এলাম। ওকে এক ঝলক দেখার জন্য বন্ধুর বাইক ছিনিয়ে নিয়ে এক ঘন্টার ড্রাইভে সেখানে গিয়েছি। হুট করে মনে হচ্ছিল ওকে না দেখলে মরে যাবো আমি। ওর বারান্দায় ও এসে বসেছিল তখন, খোলা চুল গুলো দুই কাঁধে আর পিঠের উপর পড়ে আছে। রাস্তা থেকে ছুটে আসা নরম আলোয় সত্যি সত্যি পরী মনে হচ্ছিল ওকে, যেন পিঠে খুঁজলেই একজোড়া লুকানো ডানা পাওয়া যাবে। ওকে দেখার পর আমার অশান্ত মন শান্ত হয়ে গেছে। এই মেয়েটা আমার অক্সিজেন। খুব ভালো করে বুঝে গেছি, ওকে ছাড়া আমি বাঁঁচব না। কবে আমার পরীটা উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরুবে আর আমি আমার মনের কথাটা বলব? কবে ওকে আমার বুকে জড়িয়ে মন জুড়াতে পারব? নাহ, ওর একটা ছবি লাগবে। কোথায় পাবো ছবি? না পেলে আঁকতে হবে। এভাবে হয় না! ওকে না দেখলে মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এই পরী, তুমি কি আমাকে কখনো বুঝবে?"

তরী পরের পৃষ্ঠা উলটে একটা মেয়ের ছবি দেখতে পেলো, আর বিস্মিত হয়ে মুখে হাত চাপা দিল। নীরবে ওর চোখের কোণা বেয়ে পানি ঝড়তে শুরু করেছে। জিসান ওকে ভালোবাসত?! এই তরীকে?! তরীকেই বারবার পরী ডাকছে?! ওর মনে পড়ল, কলেজে থাকতে ওরা আনসার ক্যাম্পে থাকত, পরে ওরা বাসা বদলিয়েছে। তরী ডায়রীতে আঁকা নিজের স্কেচ বারবার ছুঁয়ে দেখছে। এই মানুষটা এত আগে থেকে ওর জন্য ভালোবাসা পুষে রেখে এসেছে? তবে যে কোনো দিন বললো না ওকে? তরী ভয়াবহ অভিমানে শব্দ করে কাঁদছে। আশেপাশের সবকিছু যেন কেঁদে উঠল, আকাশ থেকে তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ছটা ওকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। তরী ডায়রিটা বুকে চেপে কাঁদছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে আজ আর গতকালের সারাদিনের জন্য। নাহ, শুধু এ অল্প দিনের জন্য না, শুরু থেকে আজ অব্দি প্রতিটা দিনের জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আর অভিমান হচ্ছে জিসানের উপর, কেন জানালো না ওকে? একটা বার কেন চেষ্টাও করলো না? এই ডায়রি না পেলে কখনো কি ও জানতে পারত কতটা ভালোবাসা পুষে রেখেছিল সে?

কান্না শেষে নিজেকে শান্ত করে আবার ডায়রি খুলে বসল। সেখানে পর পর কয়েক পৃষ্ঠায় তরীর চুল খোলা, চুল বাঁধা, চশমা পরা, চশমা ছাড়া দাঁত বের করে হাসার ছবি। কি সুন্দর আঁকার হাত ওর! তরী ঝাপ্সা চোখ বারবার পরিষ্কার করে দেখছে। ঠিক কতটা ভালোবাসা থাকলে ওর ছবি ডায়রিতে স্কেচ করে রাখে? এরপরের পৃষ্ঠায় লিখা-

"আমার পরীকে আজ অনেক দিন ধরে দেখছি না। এলাকায় নেই নাকি ওরা, কোথাও বেড়াতে গিয়েছে। আহ, আমার হবু শ্বশুর মশাই কি জানে যে সে তার হবু মেয়ের জামাইয়ের অক্সিজেন সাপ্লাই কেটে দিয়েছে? কি করে থাকব আমি ওকে ছাড়া? মাঝে মাঝে নিজের উপরই বিরক্ত লাগে। প্রেমে কি আমি একলাই পড়েছি? পৃথিবীতে আর সব প্রেমিকরা কি করে বাঁচে?"

"আমার পরী যে আমার এত বড় দুর্বলতা হয়ে দাঁড়াবে, আমি ভাবতে পারিনি। আজ আমার এলাকার এক বন্ধু বাজে ইঙ্গিতে ওর প্রশংসা করছিল। আমি দুই ঘুষিতে ওর নাকের বারোটা বাজিয়েছি। এই নিয়ে আমাদের মাঝে এলাহি কারবার হয়েছে। কয়েকজন আমাকে মাফ চাইতে বলেছে। কেন চাইব, কেন? আমার পরীকে নিয়ে কেউ একটা টুঁ শব্দও করতে পারবে না, টুঁটি ছিঁড়ে ফেলব! আমার পরী শুধু আমার হবে। আমার তরী, আমার পরী!"

"গত কয়েকদিন জ্বরে পুড়ে মরছি। আম্মু মরাকান্না লাগিয়েছে বাসায় আমার জ্বর বলে। এলাকার একটা মানুষ, এমন কি আমার আত্মীয়স্বজনরাও কেউ বাকি নেই বোধহয় জানার। কি করে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলি যে, আমার পরী আমার কপালে হাত রাখলেই আমি সুস্থ হয়ে যেতাম? ইশ, কেউ যদি বিয়ের কথা বলত, আমি সোজা পরীর কথা বলে দিতাম। অবশ্য চাকরি না করে এসব কথা বলা এই সমাজে পাপ। সমস্যা নেই, চাকরি পেতে পেতে আমার পরীও পরিপক্ক হয়ে যাবে। ততদিন ধৈর্য্য ধরতে হবে। গত এক বছরে বুঝেছি, আমি ভয়াবহ রকমের ধৈর্য্যশীল মানুষ!"

"সামনে মাস্টার্স এর ফাইনাল সেমিস্টার পরীক্ষা। এতদিন যাইই করেছি, এখন আর মাথায় পরী ছাড়া আর কিছু ঘোরে না। ওর ইন্টার পরীক্ষা শেষ, আর আমার ফাইনাল শুরু হচ্ছে। তবে আমাকে এসব ভাবলে চলবে না। খারাপ সিজিপিএ দিয়ে যদি চাকরি না জোটে? যদি পরীর বাবা আমাকে ওকে না দেয়? এই রিস্ক নেয়া যাবে না। পড়তে হবে আমাকে, প্রচুর পড়তে হবে!"

"আজ খালা বলছিল আমার বিয়ের কথা, অবশ্যই মজার ছলে। তারা খুব চিন্তিত, কেমন না কেমন মেয়ে জোটে আমার কপালে, তাই ভেবে! আমি মনে মনে হাসছিলাম। ওরা কি জানে আমি কাকে পছন্দ করেছি? জানলে চিন্তা করত না!"

"আমি আজকে লিখতে পারছি না, হাত কাঁপছে। ভাগ্যিস আমি ওকে সবসময় ফলো করার চেষ্টা করি। আজ আমি না থাকলে আমার পরীও হয়ত আর বেঁচে থাকত না! রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা সিএনজি ওকে ধাক্কা দিয়ে বাসের নিচে ফেলেছিল! কেবল আমি একটুর জন্য ওকে ধরে ফেলেছিলাম। ততক্ষণে অবশ্য ওর মাথা রাস্তায় ঠুকে গেছে, ও জ্ঞান হারিয়েছে। পরী আমাকে দেখেনি। ওকে কোলে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। কখন ওর হাত পা কেটে রক্তে রক্তে আমার পুরো শার্ট ভিজে গিয়েছিল, কে জানে! হাসপাতালে আসার পর বলেছে ওর রক্ত লাগবে। আমার আর ওর রক্তের গ্রুপ যে এক, সেটা কি ও জানে? আমিই রক্ত দিলাম। সাথে আমার ছোট ভাই ইমরান ছিল। ওকে মেয়েটার পাশে বসিয়ে রেখেছিলাম। আমার মাথা এত ঘুরাচ্ছিল যে ওকে একবার দেখে ইমরানকে ওখানে রেখে চলে এসেছি। আসলে রক্ত দেয়ায় না, ওকে এই অবস্থায় দেখে পালপিটিশান বেড়ে গিয়ে আমার এই হাল। ওকে এই প্রথম ছুঁলাম, তাও আবার কোলে নিলাম! ওকে কি যে ভালোবাসতে ইচ্ছা হচ্ছিল, বলে বুঝাতে পারব না। মন চাচ্ছিল বুকের সাথে একেবারে মিশিয়ে রাখি! আর লিখতে পারছি না। ইশ, একবার ওর মুখখানা দেখতে পারতাম! ওর টোল পড়া গাল ছুঁয়ে দিতে পারতাম!"

"আমি সেদিন ভাবতেও পারিনি নিজের কত বড় সর্বনাশ করে বসেছি। দুইদিন পর ওকে দেখতে যাবো, তখন দেখলাম ইমরান ওর সাথে। আমি আর ওর সামনে যাইনি। আজ ও আমার খালার বাসায় বেড়াতে এসেছে। ওকে ডেকে জিজ্ঞাসা করার পর বলল, আমার পরী ওর কাছে ইমরানকে দেখে ভেবেছে ইমরান ওকে বাঁচিয়েছে। বারবার ওকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। ইমরানের ওকে অনেক ভালো লেগেছে। আমার কাছে এসে বারবার অনুরোধ করেছে আমি যেন সত্যটা না বলি। ও নাকি আমার পরীকে ভালোবেসে ফেলেছে! এটা তুই কি করলি ভাই? এরচেয়ে আমার কলিজা চাইতি, আমি তোকে দিতাম। আমার সব সম্পদ নিয়ে নিতি, তবুও কিছু বলতাম না! তুই কি চাইলি আমার কাছে? আমার পরীও নাকি ওকে অনেক পছন্দ করেছে! হবেই তো, আমার ভাই না? কিন্তু এই সত্য আমি কি করে হজম করব? গত দেড় বছর ধরে আমি ওকে সামলে রেখেছি সব ছেলের নজর থেকে! অথচ এমন এক জনের নজর পড়ল যাকে চাইলেও আমি কিছু বলতেও পারব না, টোকা দেয়া দূরে থাক। আল্লাহ, কেন আমাকে এত বড় পরীক্ষায় ফেললা তুমি?"

তরী এইটুকু পড়ে আবার কেঁদে ফেলল। ওর স্পষ্ট মনে আছে ও অজ্ঞান হবার আগ মুহুর্তে একটা শার্ট দেখেছিল যেটা ইমরানের গায়ে ছিল। ও ভেবেছিল, ইমরান ওকে বাঁচিয়েছে। অথচ এটা ও কি পড়ল?! ওকে সেদিন জিসান বাঁচিয়েছে? জিসান ওকে রক্ত দিয়েছে? ইমরান না?! এই ঘটনার পর থেকে ও ইমরানকে খুব দ্রুত ভালোবেসে ফেলেছে। অথচ ওর ভালোবাসা পাওয়ার লোভে ইমরান মিথ্যা বলেছে? আর ওকে এত বছর সামলে রেখে জিসান সত্য চাপা দিয়ে থেকেছে? তরীর রাগ হচ্ছে নিজের উপর, ইমরানের উপর, নিজের ভাগ্যের উপর, জিসানের উপর। কে বলেছে ওকে সেক্রিফাইস করতে?

তরীর সমস্ত পৃথিবী নড়ে উঠেছে। ও পরের পৃষ্ঠাগুলো কাঁদতে কাঁদতেই খুললো। আজ এর শেষ দেখে ছাড়বে।

"আমার ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে একবারও বলতে পারলাম না পরী আমার প্রেম, আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান নারী এই মুহূর্তে, ও আমার দেড় বছরের সাধনার ফল! ইমরানকে যতবার বলতে গিয়েছি, পারিনি। কি করে পারব? আব্বু মারা যাওয়ার পর চাচা আমাদের দেখে রেখেছে, ইমরান আমার আপন ভাইয়ের মত আমার সাথে থেকেছে। কি করে ওকে বলব, তোর পছন্দের মানুষ তোর হতে পারে না, আমার? কি করে তরীকে গিয়ে বলব, ঐদিন তোমাকে আমি বাসের নিচে পড়া থেকে বাঁচিয়েছি? তোমার শরীরে আমার রক্ত বইছে? পৃথিবীতে কিছু মানুষ নাকি সেক্রিফাইসের জন্য আসে। আমি আসলাম! আমার কিছুই করার নেই"

এরপর ওদের বিয়ের তারিখ দিয়ে লিখা-
"আমার তরী আজ অন্য ঘাটে ভিড়েছে। আজ থেকে আমার সব শেষ। ভাবছি খুব শীঘ্রই এই দেশ ছেড়ে চলে যাবো। বিদেশে এপ্লাই করেছি। আমি চাই না আমার প্রিয় মানুষ দুটো অসুখী থাকুক, আমার কালো ছায়া পড়ুক। আমি চাই, ওরা ভালো থাকুক, আমার কাছে থাকলে যতটা থাকত তার চেয়েও বেশি!"

এরপরের বেশ কিছু পৃষ্ঠা পরে লিখা-
"আজ আমার পরীর একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। আমি ওকে কোলে নিয়ে অনুভব করলাম, আমি বাবা হয়েছি, এই ছেলেটা যে আমার হওয়ার কথা ছিল! কেবল ওর মাকে আমি পেলাম না নিজের বোকামির জন্য। যদি বলে দিতাম সময় থাকতে, তবে এই দিন দেখতে হতো না। অবশ্য আফসোস নেই। ওদের হাসিখুশি দেখে মনে অনেক শান্তি লাগে। ওদের ছেলে নাম রাখার গুরু দায়িত্বও আমার উপর পড়ল। ওর নাম রাখলাম ইশতি৷ ও আমার ছেলেই। ইশতি, আমার 'হতেও পারত ছেলে'!বাবা, অনেক স্পেশাল তুই আমার জন্য, সেটা কি তুই জানিস?"

এরপর আর কিছু নেই। তরী অনেকটা সময় নিয়ে শান্ত পুকুরপাড়ে বসে থাকলো। কি করবে ও? কাকে কি বলবে? এই সত্য কি করে মেনে নেবে? চোখের জল মুছে একটা রিকশা করে কবরস্থানের সামনে এসে নামলো। হ্যাঁ, এখানের সে শুয়ে আছে।  বৃষ্টিতে সে অনেকটাই ভিজে গেছে। দূর থেকে ইমরানের কবর দেখা যাচ্ছে। তরী দূর থেকে ফিসফিস করে বলল,
"শুনতে পাচ্ছো আমার হৃদয়ের আর্তনাদ ইমরান? শুনতে পাও? কেন মিথ্যা বলেছিলে সেদিন? কেন? যদি সত্যিটা বলতে তাহলে কি দুই দুটো মানুষের জীবন এমন হতো? আমাকে কি অল্প বয়সে স্বামীহারা হতে হতো? কেন এসেছিলে সেদিন তোমার ভাইয়ের সাথে? হয়ত ক্ষণিকের এই পৃথিবীতে তোমার অল্প কিছু পাওনা ছিল, তাই অল্প কিছুই নিয়ে গেলে। আমি মাফ করে দিলাম তোমাকে, কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখেছিলে, আমাকে দুটো সন্তান উপহার দিয়েছ বলে। তবে বিশ্বাস করো, শেষ বিচারের দিন আমি তোমার সাথে থাকবো না! আমি তার কাছেই থাকব যার কাছ থেকে একটা মিথ্যা দিয়ে তুমি সরিয়ে দিয়েছ। মিথ্যুক তো জিসান নয়, মিথ্যুক তো তুমি ইমরান, তুমি! তবুও আমার অভিযোগ নেই। কারণ মৃত মানুষের উপর অভিযোগ রাখতে নেই, অভিযোগ করেও লাভ নেই। না আমাদের সেই সময়টা ফিরে আসবে, না আমার জীবন বদলে যাবে। তবে এতদিন ধরে যে ভুল করে এসেছি, সেই ভুল আর করব না। এতদিন ভাবতাম আমি তোমাকে কিভাবে ফেস করব? কি জবাব দেব? সজ থেকে তা আর ভাববো না। আমার ভুল শোধরানোর দিন এসেছে। আজ আমার বুকের উপর থেকে অনেক বড় বোঝা নেমে গেছে। তুমি ওপাড়ে ভালো থেকো ইমরান, অনেক ভালো থেকো। আল্লাহ তোমাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা হিসেবে কবুল করে নিন! আর আমাকে এই পৃথিবীতে জান্নাতের সুখ খুঁজে নেয়ার তৌফিক দিন!"

চলবে...

Bạn đang đọc truyện trên: Truyen2U.Pro