১০ ও শেষ পর্ব

Màu nền
Font chữ
Font size
Chiều cao dòng

#দ্যা_রঙ_নাম্বার_কেবিন
লেখা #AbiarMaria

#১০ ও শেষ পর্ব

ট্রেন যখন চৌদ্দগ্রাম পার হয়েছে, তখন রাইমা রাগ করে ফোন বন্ধ করে দিল। যাইমা বেশ কয়েকবার কল করেছে, ওর রিসিভ করতে ইচ্ছা করেনি। বাসায় ফেরার পর সবার প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়েও একটা প্রশ্নের উত্তরও দেয়নি, চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। চোখের কোণ বেয়ে অজান্তেই দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে। কি এক নিদারুণ অভিমানে রাইমার মন ভেঙে গেছে। সামনে যা হবে, তা কি হবে ও জানে না। নিজেকে বড্ড সস্তা লাগছে। আচ্ছা, পৃথিবীতে আর কোনো ছেলে কি নেই? কেন এর কাছে সমর্পন করতে হবে নিজেকে? রাইমা উঠে বসল। আজ থেকে সে এক নতুন মানুষ হবে।

তিন সপ্তাহ পরের কথা।

রাইমা দরজা আটকে বসে বসে পড়াশোনা করছে। ওর মা এসে দুইবার ধাক্কা দেয়ার পরও খুলেনি। সামনে যে অংক নিয়ে বসে আছে, ওটা ওর ব্রেইনের কয়েকটা নিউরোনকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এই অংক তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, অথচ পরীক্ষার আগের রাতে এর সমাধান খুঁজে না পাওয়ার মত বোকা তো ওর হওয়ার কথা না! অংক নিয়ে মাথা ঘামাতে ঘামাতে তৃতীয় বারের মত ওর মা দরজায় ধাক্কা দিলেন। রাইমা বিরক্ত হয়ে দরজা খোলার সাথে সাথে তিনি বিরক্তি ঢেলে দিলেন ওর গায়ে।

"এতক্ষণ খুলিস নি কেন দরজা? কি হয়েছে তোর?"
"আম্মু, আমার কাল পরীক্ষা। প্লিজ, জরুরি কিছু থাকলে বলো। অন্য কিছু আমি শুনতে চাচ্ছি না। এমনিতেই পড়া মাথায় ঢুকছে না, তার উপর তুমি যা বলবা, সেটাও ঢুকবে না"
ওর মা বিরক্তির থার্মোমিটার ঠান্ডা করার চেষ্টা করলেন।
"শোন, তোর জন্য এজন্য ভালো সম্বন্ধ আসছে। ছেলে..."
"আবার শুরু করেছ তোমরা? আমি ভেবেছিলাম তোমরা কেউ আগামী ছয় মাসেও ও পথে পা বাড়াবা না। মানে কি এসবের? দুই মাসও পার হলো না, এর মাঝেই শুরু করে দিয়েছ?!"
"দেখ, সবসময় ভালো সম্বন্ধ আসে না। আমাদেরও তেমন ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু ছেলে আর ওর পরিবারের কারণে আগাচ্ছি। তোর এরপরের পরীক্ষা কবে?"
"কেন? তোমরা কি বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলছ?!"
"ওরা তোকে দেখতে আসবে!"
"আমার আগামী সপ্তাহ পুরোটা পরীক্ষা থাকবে। তারপরের সপ্তাহ থেকে ছুটি। কিন্তু তার মানে এই না যে তখন তোমরা... "

রাইমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর মা উঠে গেল। ওরা এক সপ্তাহ পরে আসলেই হবে। মেয়ের অমত, দ্বিমত, এসব শুনে কাজ নেই। ভালো যায়গায় আল্লাহ আল্লাহ করে মেয়ের বিয়ে এখন হলেই হয়। পাত্রপক্ষ যা কেলেঙ্কারি করল আগের বার! এবার আর মেয়ের গায়ে আঁচড় লাগতে দেয়া যাবে না।

এদিকে রাইমা বিরক্ত হয়ে আবার অংকের দিকে মনোযোগ দিল। ওর মায়ের কথা ধরলে পরীক্ষাতে দুটো হাঁসের ডিম আনতে হবে। আজকাল হাঁসের ডিমের যা দাম! পরীক্ষা খারাপ হলে কপালে সেটাও জুটবে না।

এক সপ্তাহ পর রাইমা শনিবার সকাল সকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওনা দিল। আজকে বান্ধবীদের সাথে বেশ কিছু ঘোরাফেরা আছে, ডিপার্টমেন্টেও কিছু কাজ পড়ে গেছে। সব শেষ করে তিনটার দিকে বাসায় ঢুকে বেশ অবাক হয়ে গেল, কারণ ড্রইংরুমে ওর চাচ্চু বসে আছে। চাচ্চুকে দেখে সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে দেখল ওর মামীও এসেছে। রাইমা কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ওর মা ওর দিকে তেড়ে আসলো।

"সারাদিন কোথায় ছিলি তুই?! এতক্ষণে তোর বাসায় আসার সময় হলো?!"
রাইমা ভড়কে গেছে।
"কি সমস্যা! সকালে তো বলোনি যে আমাকে বাসায় থাকতে হবে। তাহলেই না তাড়াতাড়ি আসতাম! আজকে বাসায় এত মানুষ? কিছু হয়েছে নাকি?"
"কোথায় এত মানুষ? তোর মামা আর চাচাই তো। আর তোর মামীকে একটু আসতে বলছি"
"হঠাৎ এসব?"
"তুই গিয়ে গোসল কর, যা! ঘামে কি হয়ে গেছিস! যা যা"

রাইমা অবাক হয়ে ঘরে গিয়ে আয়নায় দেখে। ওর মা যেভাবে নাক ছিটকেছে, তেমন তো ঘামে নি! বিরক্তি নিয়ে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিল। খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ওর মা আবার ঘরে প্রবেশ করল।
"এই শাড়িটা পর"
"শাড়ি?! এখন? কেন?!"
"ছেলেরা তোকে দেখতে আসবে"
"মানে?! আগে তো এসব কিছু বলোনি!"
"এখন তো বললাম! যা তৈরি হ!"

অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাইমা তৈরি হয়ে নিল। মনে মনে কেবল প্রমাদ গুণছে, কোন ছেলেকে এবার দেখা দিতে হবে, আবার ওর ভাগ্যে কি হবে, আল্লাহই জানেন!

পাত্রপক্ষ বাসায় আসলো ঠিক সন্ধ্যার দিকে যখন সবাই মাগরিবের নামায মাত্র শেষ করেছে। হুট করে বাসার সবাই খুব চঞ্চল ভঙ্গিতে ছোটা শুরু করেছে। যাইমা রান্নাঘর ছেড়ে বোনকে সাজিয়ে দিচ্ছে। রাইমা বেশ বিরক্ত হয়ে বলল,
"কি শুরু করলি সবাই মিলে? এত সাজার কি আছে? আমি যেমন, তেমনই দেখবে। পছন্দ না হলে নেই!"
"তুই এত বিরক্ত না হয়ে চুপ করে বস। আমি তোকে হালকাই সাজিয়েছি!"

পুতুল সেজে পাত্রপক্ষের সামনে যাওয়ার পর তারা তেমন কোনো প্রশ্ন করল না, কেবল পাত্রের মা রাইমাকে বললেন,
"বিয়ের পর ক্যারিয়ার নিয়ে কি প্ল্যান?"
মহিলার শুদ্ধ কথার টানে রাইমা মুখ তুলে তাকাতে বাধ্য হলো। ছেলের মাকে মুরুব্বির মত লাগছে না, বরং চল্লিশোর্ধ্ব মনে হচ্ছে। কি পরিপাটি! রাইমা একটু ভেবে জবাব দিল,
"পড়াশোনা শেষ করব আগে। তারপর কোনো প্রাইভেট কোম্পানিতে জয়েনের ইচ্ছা আছে। সময় ও সুযোগ হলে সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করব"

ওর বাবা বা চাচা রাগ হলেন কিনা জানি না, তবে পাত্রের মাকে বেশ সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে। রাইমা এখনো বুঝতে পারছে না কিছু। ওর বাবার ইশারায় একটু পর ও উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। ফোন বের করে কয়েকটা সেলফি তুলে নিল। মনে মনে ক্যাপশন ঠিক করল, জাস্ট গট রিড অফ দ্যা প্রেশার! হায়, ও যদি জানত যে আসলে প্রেশার মাত্র শুরু হয়েছে!

আধা ঘন্টা পর ওর মা এসে যাইমাকে বললেন,
"ওকে সাজাচ্ছিস না কেন?! ছেলে এক্ষুনি চলে আসবে! ও কি এভাবে বিয়ে করবে নাকি?"
রাইমা রীতিমতো লাফিয়ে উঠল।
"বিয়ে মানে?! উনারা না আমাকে শুধু দেখতে এসেছে?এখন বিয়ের কথা আসছে কেন?!"
"শুধু আংটি পরানোর কথা ছিল, এখন ওরা আজকে বিয়ে পড়াবে। তোর মামা কাজী আনতে গেছে। এত কথা বলে এখন সময় নষ্ট করিস না!"

ওর মা চলে যেতে চাইলে রাইমা হাত চেপে ধরল।
"কি মাথা খারাপের মত কথা বলছ তোমরা?! আমি তো ছেলেকে দেখলাম না, জানিও না কিছু! আমার মতামতের কোনো দাম নেই নাকি?!"
"আমরা যা করছি, ভালোর জন্য করছি। ছাড় এখন, অনেক কাজ আছে আমার"
যাইমার দিকে ফিরতেই ও আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করে বলল,
"আমি কিন্তু কিছু জানি না এসবের!"
"আমাকে এভাবে ব্লাইন্ড ফোল্ডেড করে ধরে বেঁধে বিয়ে দেয়ার মানেটা কি?! তুই আব্বুকে ডাক!"

ওরা দুবোন শত চেষ্টা করেও ওদের বাবাকে ভেতরে ডাকতে পারলো না, ওদের বাবা এলেন না। রাইমা অবাক হয়ে যাচ্ছে সবার আচরণ দেখে। ওর মামীকেও জিজ্ঞেসা করেছে, সে ছেলের ব্যাপারে খুব বেশি জানেনা। যা জানে, তাতে সেও রাইমাকে বিয়ে করে ফেলার জন্য ঠেলছে।

এরপরের দু'ঘন্টার মাঝে কি হলো, তা রাইমার বোধগম্য হলো না। ঝড়ের মত ওর চারপাশ বদলে গেছে। যাইমা বকা খেয়ে বোনকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। ওদিকে ছেলের মা এসে ওকে ছোট নেকলেস আর কানের দুল পরিয়ে গেছে। সাথে আংটিও পরিয়েছেন। এরপর কবুল বলার আগে পর্যন্ত তিনি আর তার মেয়ে রাইমার দুপাশে বসে থাকলেন। রাইমা চাইলেও খুব বেশি কিছু করতে পারেনি। আগে ও শুনেছে কেবল, অমুকের দেখতে এসে বিয়ে হয়ে গেছে। আজ এই প্রথম নিজেকে দিয়ে এই ঘটনার অভিজ্ঞতা হলো।

বিয়ে পড়ানোর পরও রাইমা ঘোরের মাঝে বসে আছে। ওর মা ছলছল নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। মাকে দেখে হুট করে রাইমার মনে হলো, ও বুঝি পর হয়ে গেছে! এখন বুঝি এই বাড়ি ছাড়ার সময় কবে হবে, তা বসে বসে গুণতে হবে? যাইমার চোখেও পানি। বিয়ে পড়ানোর পর তাদের খাবারের আয়োজন করতে হলো। খাবার শেষ হওয়ার পর রাইমাকে ড্রইংরুমে নেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। যখন ওর বরের পাশে ওকে বসানো হলো, তখন ওর কেমন যেন কান্না পাচ্ছিল। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, এই লোককে সে মুখ তুলে দেখবে না। কেমন মানুষ সে যে একটা মেয়েকে না দেখে বিয়ে করে ফেলে? তার উপর একাবারও কি ওকে জিজ্ঞাসা করতে পারত না ওর মতামত আছে কিনা? রাইমা অভিমানে অশ্রু ঝরাতে শুরু করেছে। যাইমা ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
"কেঁদে নে আপু, যত খুশি কেঁদে নে! জিজু তোকে এরপর আর কাঁদার সুযোগ দিবে না!"

রাইমার এ কথা শুনে আরও বেশি কান্না পাচ্ছে। ওর বোনও কি বুঝতে পারছে না ওর কত অসহায় লাগছে? লোকটা পাশে বসে কেবল পোজ দিচ্ছে, কিন্তু কোনো কথা বলছে না।

ছেলেপক্ষ ছেলেকে নিয়ে যেতে চাইলেও রাইমার পরিবারের লোকজন ছেলেকে যেতে দিল না। তাদের মতে, বিয়ের পর ছেলে মেয়েরা আলাদা কেন থাকবে? আজ বেড়িয়ে বরং দুদিন পরেই যাবে। রাইমাকে ততক্ষণে ফটোসেশন শেষে ওর ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। কোত্থেকে যেন কত গুলো ফুল আবিষ্কার হয়েছে। একটা টবে বেলী আর আরেকটা টবে গোলাপ সাজিয়ে সেটা রাইমার বিছানার পাশে রাখা হয়েছে। আর বিছানার উপরে গাদা ফুল ছিড়ে পাপড়ি ছিটিয়ে দিয়েছে। রাইমা ভাবতেও পারছে না, অপরিচিত একজনের সাথে আজকে তাকে বাসরও করতে হবে! অবিশ্বাস্য!

যাইমা ওকে জোর করে মাথায় বড় করে ঘোমটা টেনে বসিয়ে রাখলো। বোনকে আর কিছু বলার ইচ্ছা হচ্ছে না ওর। সবার মত ওর বোনও নাচতে নাচতে ওর বিয়ের সব কাজ করছে যেন কি এক আনন্দের দিন! ওদিকে রাইমার মরো মরো দশা। দাঁতে দাঁত চেপে সে বিছানায় বসে আছে। মনে মনে ভাবছে, আজকে আসুক বাছাধন, কিলিয়ে বাসর করার মজা বুঝাবো!

যখন সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি ঘরে প্রবেশ করল, রাইমা আঁচলের ফাঁক গলে আবছা ভাবে দেখল পাঞ্জাবি পরা মানুষটাকে ঘরে ঢুকতে, চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। রাইমা অনেক ভাবে চেষ্টা করছে ঠিক করার, আসলে মানুষটাকে ঠিক কি বলবে? রাগ দেখাবে? থ্রেট দিবে? কান্না করবে? নাকি নিরুত্তর থাকবে? শেষে নিরুত্তর থাকাকেই শ্রেয় মনে হলো।

মানুষটা একটা উপহারের ছোট বাক্স বের করে বলল,
"আপনার জন্য, যদি গ্রহণ করেন। তবে আমি নিজে হাতে আপনাকে পরিয়ে দিতে চাই। যেহেতু দেন মোহর পুরোটা শোধ হয়নি, আমি কি আপনাকে এটি পরিয়ে দেয়ার অনুমতি পেতে পারি?"

রাইমার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে, মনে হচ্ছে মাথা ঝিমঝিম করছে। লোকটার কন্ঠস্বর হয়ত একারণে পুরোপুরি ধরতে পারছে না, তার কথা গুলো মাথায় '৯৮ উইন্ডোজ এর কমপিউটারের মত এখনো প্রসেসিং হচ্ছে। ও কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো যদিও কেন সম্মতি দিল, তা জানে না। মানুষটা ওর ঘোমটা তুলে দেখল, রাইমা চোখ বন্ধ করে রেখেছে। সে ঘোমটা ফেলে দিয়ে বক্স থেকে লকেট সহ একটা চেইন ওর গলায় পরিয়ে দিল।

রাইমার মনে হচ্ছে, এই লোকটার পারফিউম আগে কোথাও পেয়েছে, ঘ্রাণ পরিচিত মনে হচ্ছে। মানুষটা সোজাসুজি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রাইমা চোখ খুলে তাকে দেখে ভূত দেখার মত লাফিয়ে পেছন দিকে হেলে পড়ল।
"আপনি?!"

আরহাম হাসছে।
"তোমার বর আমি, তো তাহলে আমিই তো থাকব। আর কে থাকবে?"
রাইমা বিস্ফোরিত চোখে আরহামকে দেখছে। নাহ, এ অলীক! এ কল্পনা! এরকম কিছু হচ্ছে না!

ওর হতভম্ব ভাব দেখে আরহাম বেশ মজা পেলো। বিছানার এক কোণে সরে এসে বলল,
"তুমি কি জানতে না যে আজকে আমার পরিবার তোমাকে দেখতে আসবে?!"
"আশ্চর্য! আমি তো জানতামই না যে আমাকে কেউ দেখতে আসবে!"
"বাহ, একেবারে অন্ধ বিশ্বাস তোমার পরিবারের উপর! ভালোই হলো, বিরাট একটা সারপ্রাইজ দিয়ে ফেললাম না জেনেই!"

রাইমার রাগ হচ্ছে খুব।
"সেদিন আমাকে একবারও কল দেননি কেন? আর ট্রেনেও আসেন নি কেন?!"
"কারণ আমার পরিবারকে ম্যানেজ করতে পারছিলাম না। ভেবেছিলাম, আমার পরিবারের কারণে তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। এজন্য কোনো কমিটমেন্ট দিয়ে তোমাকে আর কষ্ট দিতে চাইনি"
"কিন্তু এর মাঝে একবারও যোগাযোগ করলেন না কেন?! আমাকে কি একবার কল করা যেত না?!"
"আমি ভেবেছিলাম আমার সিভি দেখে তুমি আমাকে কল দিবে। তুমি দাওনি দেখে আমি ভেবেছি, রেগে আছো। এজন্য আমি চাচ্ছিলাম একেবারে তোমার বাসায় এসে তোমার ভুল ভাঙাবো"

রাইমা আরহামের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। খাটের আয়নার সাথে হেলান দিয়ে উলটো ঘুরে কাঁদতে বসলো। ওকে কাঁদতে দেখে আরহাম এগিয়ে এসে ওর পেছনে বসে কাঁধে হাত রাখলো। রাইমা ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
"খবরদার, একদম ভালো হবে না আমাকে ছুঁলে! একদম আমাকে ছুঁবেন না আপনি!"
আরহাম তবুও দুহাতে ওর দুই কাঁধ জড়িয়ে ঘাড়ে থুতনি ঠেকালো।
"আমি খুব সরি, প্লিজ! এত রাগ করে না?"
"রাগ করব না? আপনি আমাকে এতদিন কষ্ট দিলেন কেন? কেন? কেন? কেন?"

আরহাম ফিসফিস করে বলল,
"খুব ভালোবাসি, তাই দুজনে মিলে ধৈর্যের পরীক্ষা দিলাম। তোমাকে কষ্ট দেয়ার ভয়েই তো আমি লুকিয়ে ছিলাম!"
রাইমা এবার আরহামের দিকে ফিরে ওর কাঁধে নাক মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। এ তো নিঃসন্দেহে সুখের কান্না। তবুও আরহামের এত কান্নাকাটি ভালো লাগছে না। ফিসফিস করে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
"ভাগ্যিস, সেদিন রঙ কেবিনে ঢুকে পড়েছিলে! ঐরাতে তোমার সব রূপ দেখেছি, শুধু এই কান্না করে নাক লাল হওয়ার রূপ দেখাই বাকি ছিলো! আরও একটা রূপ অবশ্য দেখা বাকি!"
"কোনটা?", রাইমা মুখ ফসকে বলে ফেলল।

আরহাম ওকে লজ্জায় লাল করে দিতে বলল,
"তোমার লজ্জা ভাঙানোর সময়কার রূপ!"
রাইমা লজ্জা আর অভিমানে আরহামকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
"আমাকে এতগুলো দিন কাঁদিয়ে এখন আদিখ্যেতা হচ্ছে, না? কাছে আসবেন না একদম। আমার ভালো লাগছে না!"
আরহাম ছোঁয়ার চেষ্টা করলেই রাইমা ওকে সরিয়ে দিচ্ছে। তাই সে জোর করে রাইমার কোলে মাথা রেখে শুলো। রাইমা তাও জোর করে ওকে ঠেলে উঠিয়ে দিল। আরহাম হাসি মুখে প্রশ্ন করলো,
"অভিমান কি খুব বেশি হয়ে গেছে সুন্দরী? ভাঙতে কি খুব দেরী হবে?"
রাইমা জবাব না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে থাকলো। আরহাম আচমকা ওর মুখখানা ধরে তাতে এলোপাতাড়ি চুমু খেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় রাইমা একেবারে হতভম্ব হয়ে বসে আছে। এটা কি হলো! আরহাম কি করলো এটা?! এই সুযোগে আরহাম আলতোভাবে ওর ঠোঁটের দখলটাও নিয়ে নিল।

রাইমার মনে হলো সমস্ত শরীরে কেউ এনেস্থিসিয়া দিয়ে অবশ করে দিয়েছে। আরহামের আলতো স্পর্শে একেবারে জমে গেছে ও।

কতক্ষণ ছিল এভাবে? দশ কিংবা বিশ সেকেন্ড? অনন্তকাল তো নয়! অথচ রাইমার সেটাই মনে হলো। আরহাম মুখ তুলে ওকে বুকের সাথে চেপে ধরলো। প্রায় শোনা যায় না, এমন ফিসফিস করে বলল,
"তুমি আমাকে যত ভালো মানুষ ভাবো, আমি আসলে ততটা না। সেদিন ট্রেনে বারবার তোমার ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়ার লোভ হচ্ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, তোমাকে বুকের সাথে ঝাপটে ধরে একটা দমবন্ধ করা চুমু খাই! যদি সামির যায়গায় আমি হতাম, নিশ্চিত থাকো সেদিন তোমাকে পাগলের মত আদর করতাম! আমি ততটা ভালো না যত ভালো তুমি আমাকে ভেবেছ। শুধু তুমি অন্যের বাগদত্তা ছিলে বলে..."

আরহাম থামলো। আলিঙ্গন থেকে আলতো করে ওর মুখখানা ধরলো। রাইমার চোখে পানি। আরহাম ওর দুচোখের পাতায় চুমু খেলো।
"বাসর রাত কি মেয়েরা এভাবেই কেঁদে কেঁদে পার করে?"
"কি করে বলব? আমার তো আগে বাসর রাত হয়নি। জীবনে প্রথম আপনার সাথেই বাসর রাতের প্ল্যানিং ছিল। সেখানে কান্নাকাটির প্ল্যানিং তো রাখিনি। তবুও কান্না আসছে খুব!"

আরহাম ওর দুগালে হাত রেখে হাসছে। রাইমা আবার ওর বুকে মাথা রাখলো। ও নিজেও জানে না কখন আরহাম ওর অভিমান ভেঙে ফেলেছে। ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
"এভাবেই সারা রাত বসে কাটাবে? শুবে না?"
রাইমা লজ্জায় মুখ লুকিয়ে রাখলো। জবাব দিল না। আরহাম আবার প্রশ্ন করলো,
"আলো নিভিয়ে দিই? আমাদের তো ঘুমানো প্রয়োজন"
রাইমা এবারও চুপ থাকলো। অগত্যা আরহাম উঠে গিয়ে আলো নিভিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালালো। তারপর বিছানায় আধাশোয়া হয়ে স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ধীরে ধীরে বলতে থাকলো,
"জানো, আমার জীবনটা অনেক কঠিন। যতটা স্মুদ হওয়ার কথা ছিল, ততটা হলো না। তোমার সাথে যেদিন দেখা হয়, সেদিন কেবল আত্মহত্যার কথা মাথায় আসছিল"
"যাইমা বলেছিল। কিন্তু কেন?"
"বিশ্বাসঘাতকতা আর নিতে পারছিলাম না।  আজকাল সবাই বিশ্বাসঘাতকতা করতে ওস্তাদ! যখন আমার চারপাশের সব আশার আলো নিভে গিয়েছিল, ঠিক তখন তুমি ঢুকে গেলে। তোমাকে দুবার বলতে গিয়েও পারলাম না। তারপর মনে হলো, আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি! এত দ্রুত প্রেম হয় সেটা আমিও ভাবিনি। যতবার তোমার দিকে চোখ যেতো, ততবার ইচ্ছা করতো, তোমাকে প্রপোজ করি, প্রচন্ড ভালোবাসি! তুমি এমন একটা মেয়ে যাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না। যদি আমার হবু বউ হতে, তাহলে সেদিন...!"

আরহাম থেমে গেল। রাইমা অজানা আবেগে শিহরিত হলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
"কি করতেন সেদিন?"

আরহাম ওকে শুইয়ে ওর মুখের উপর ঝুকলো। এক হাতে কোমর চেপে কাছে নিতে নিতে বলল,
"সত্যিই জানতে চাও?"
রাইমার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। সে কিছু বলতে পারছে না। আরহাম আরও কাছে এসে প্রশ্ন করলো তো,
"তার আগে একটা প্রশ্নে জবাব দাও তো। সেই রাতে তোমার আমাকে নিয়ে কি মনে হয়েছিল? খুব সংকোচ হচ্ছিল?"
রাইমা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। লজ্জায় বারবার মরে যেতে ইচ্ছা করছে। মনে হচ্ছে যেন মানুষটা ওর মনের খবর সবটুকু পড়ে নিচ্ছে। কি বলবে ও? যে আরহাম চলে যাওয়ার পর ওর বালিশ, কম্বলে চুমু খেয়েছে? কিভাবে ওকে এই মানুষটা ভালোবাসায় পাগল বানাবে, সেটা ভেবেছে? এভাবে সব স্বীকার করা যায়? রাইমা উল্টো ঘুরে বলল,
"জানি নাহ!"
আরহাম ওর আঁচল সরিয়ে ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো।
"এত লজ্জা পাচ্ছো কেন? সেদিন তো তুমিও প্রেমে পড়েছিলে। এক সাথে দুজন লাভ এট ফার্স্ট সাইটে আক্রান্ত হয়েছিলাম। একবারও ইচ্ছে হয়নি ছুঁয়ে দেখতে?"

রাইমা কোনো জবাব না দিয়ে ঘুরে আরহামকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো। ফিসফিস করে বলল,
"আপনি চলে যাওয়ার সেদিন আপনার বালিশ আর কম্বল জড়িয়ে ধরে রেখেছিলাম। কত হাজারবার যে দুয়া করেছি আপনাকে পাওয়ার জন্য!  আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমি সত্যি আপনাকে পেয়েছি!"
আরহাম আধো আলো আধো আধাঁরে প্রিয় মানুষকে একান্তভাবে জড়িয়ে নিতে নিতে বলল,
"এইতো আমি, ভালোবাসছি তোমাকে খুব! সকাল হলেও দেখবে, আমি রয়ে গেছি। আগামী দুদিনের আগে কোথাও যাচ্ছি না!"

রাইমা হেসে ফেলল।

কিছুদিন পরের কথা।

রাইমা ট্রেনের বগিতে হেঁটে হেঁটে নিজের কেবিনে যাচ্ছে। ট্রেনে উঠেই তার হাত ছলকে কফি দুহাতে কফি পড়ে গেল। তাই সে ওয়াশরুমে গিয়েছিল। আসার সময় দেখলো, ওদের কেবিনের সামনে আরেক মেয়েকে আরহাম কি যেন বলছে। কাছে আসতে না আসতেই মেয়েটা চলে গেল সামনের দিকে রাইমা এসে সেদিকে চেয়ে বলল,
"কে ওটা?"
আরহাম দুষ্টু হাসি দিল।
"আবার আরেক মহিলা রঙ কেবিনে ঢুকে যাচ্ছিল!"
"আচ্ছা?! সব শুধু তোমার কেবিনেই ঢুকে?"
আরহাম হাসতে হাসতে বলল,
"তাই তো! আমিও উনাকে সেটাই বললাম! বিয়ের আগে একজন ঢুকে গিয়েছিল, সেটা ঠিক আছে। তাকে তো বিয়েই করলাম। বিয়ের পর আবার কি করবো বলো?আরেকটা বিয়ে করার সাহস নেই একদম!"

দুজনে শব্দ করে এক সাথে হেসে উঠলো। আরহাম দুহাতে ওকে জড়িতে নিতে নিতে বলল,
"ভাগ্যিস সেদিন রঙ নাম্বার কেবিনে জোর করে ঢুকে পড়েছিলে!"

সমাপ্ত

Bạn đang đọc truyện trên: Truyen2U.Pro