আমি আবার, আর একটা বার
লেখা #AbiarMaria
৩
জিসান বাসায় ঢোকার সাথে সাথে মায়ের ফোন আসতে শুরু করেছে। ঢাকায় আসলে ও ওর খালার বাসায় এসে উঠে। কলিং বেল চাপার পর কাজের মেয়ে দরজা খুলে রান্না ঘরে চলে গেছে। ওর খালাতো ভাই বোনেরা এই সময় ভার্সিটিতে থাকে, আর খালাও সম্ভবত ব্যস্ত। জিসান নির্ভেজালভাবে গেস্ট রুমে ফিরে এসেছে। মায়ের ফোন দেখে এই মুহূর্তে ওর মনটা আরও বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে, তার সাথে এই মুহূর্তে কোনো নতুন কথোপকথনে যেতে ইচ্ছা করছে না।
জিসান ফোন রেখে শাওয়ারে ঢুকে গেল। বৃষ্টি আসবে বুঝতে পেরে সে ছাতা নিয়ে বেরিয়েছিল। তরী বেরিয়ে যাওয়ার পর ও আর বেশিক্ষণ সেখানে থাকেনি। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যেতেই ও অবাক হয়ে গেছে। আষাঢ়ের প্রবল বর্ষণের তোপে আশপাশটা ঝাপ্সা লাগছে। এমন বর্ষণে কোনো পরিবহন পাওয়াটাও তো মুশকিল। জিসান ছাতা দিয়ে নিজেকে কোনোমতে বাঁচিয়ে এক সিএনজি থেকে আরেক সিএনজির কাছে গেল। বসুন্ধরা থেকে টঙ্গী খুব বেশি কাছে না, তাই সিএনজি ছাড়া উপায় নেই। এক সময় বাসে চড়লেও আজকাল বাস মানেই ঠেলাঠেলি আর ঘামের দুর্গন্ধ মনে হওয়ায় সেখানে ওঠা হয় না। কিছুটা সামনে যেতে একটা সিএনজি খেয়াল করল, তরী রিকশায় বসে আছে, রিকশাওয়ালা চেইন ঠিক করছে। জিসান একটু এগিয়ে কন্ঠ উঁচিয়ে প্রশ্ন করল,
"তুমি তো ভিজে যাচ্ছো। সিএনজি পেয়েছি একটা। এগিয়ে দিই?"
তরী ওর দিকে একবার চেয়েই মুখ ঘুরিয়ে নিল। জিসান আবার বলল,
"এভাবে ভিজলে ঠান্ডা লাগবে। বাচ্চারাও অসুস্থ হয়ে যাবে"
তরী হাত জোড় করে ওর মতই বর্ষণের শব্দকে ছাপিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
"আমাদের নিয়ে ভাবতে হবে না"
"ঠিক আছে। কিন্তু আমার সাথে এক সিএনজিতে গেলে আমি মেরে ফেলব না। প্লিজ আসো?"
রিকশাওয়ালাও কি কারণে ওকে বলে বসল,
"ভাই জানের উপরে রাগ কইরা তার মনে কষ্ট দিয়েন না। স্বামীর পায়ের নিচে বউয়ের জান্নাত থাহে। ভাইরে নারাজ কইরেন না"
তরীর মন চাইলো বয়স্ক রিকশাওয়ালাকে চিৎকার করে বলতে যে না এই লোক তার স্বামী, না স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর জান্নাত থাকে। কিন্তু কিছু বলার আগে সিএনজিওয়ালা চেঁচিয়ে বলল,
"গেলে আসেন, না গেলে বলেন, অন্য প্যাসেঞ্জার দেখমু!"
তরীর আর কিছু বলতে ইচ্ছে করেনি। সে বিনাবাক্যে জিসানের সাথে সিএনজিতে বসে পড়ল। পুরো রাস্তা সে এমনভাবে বসে রইলো যেন জিসান নেই এখানে। শুধু বারবার ভেজা কাপড় নিয়ে টানাটানি করছিল ও। জিসান আড়চোখে কয়েকবার ওকে দেখে চোখ সরিয়ে নিয়েছে। যতই ওদের বিয়ের কথা চলুক, বিয়ে আদৌ হবে কিনা সন্দেহ। অন্তত তরীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো কিছুই হবে না। এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, তরী এমন কোনো কিছুতে মোটেও আগ্রহী নয়।
শাওয়ারের পানির নিচে দাঁড়িয়ে এসব মনে পড়ছিল ওর। তরী নিঃসন্দেহে একজন রূপবতী নারী, পাশাপাশি পুরো পরিবারের সবাই ওকে খুব পছন্দ করে। ইমরানের সাথে বিয়ের পর এমন কেউ নেই যে কিনা ওর প্রশংসা করেনি। শুরুতে চাকরি নিয়ে দ্বন্দ্ব হলেও তরী ঘরকন্নার কাজে নিজেকে অভ্যস্ত করে নিয়েছে। সন্তানদের সামলানোতেও তার জুড়ি নেই। অথচ বংশের সবচেয়ে পার্ফেক্ট বউয়ের ভাগ্যে সবচেয়ে ইম্পার্ফেক্ট টুইস্ট জুটেছে। ইজ ইট ফেয়ার?
জিসান গোসল থেকে বের হয়ে আয়নার সামনে নিজেকে দেখছে। চুল টাওয়েল দিয়ে মুছতে মুছতে খেয়াল করলো ওর মায়ের আরও দুবার কল এসেছে। কতবার বলেছে, তাকে যেন এতবার কল না দেয়, ফ্রি হলে ও নিজে কলব্যাক করবে। মায়ের মন এসব যুক্তি বোঝে না। জিসান ফোন নিয়ে বিছানায় বসলো।
"জি আম্মু, বলো"
"ফোন ধরিস না কেন? তরী কি বললো?"
"আম্মু, এসব নিয়ে কথা না বললে হয় না? আমি বুঝি না কেন তোমরা আমাদের উপর জোর করতেছ? ওর জন্য ব্যাপারটা মোটেও সহজ না!"
"আমি জানি। কিন্তু বাচ্চাগুলোর উপর তোর কি দায়িত্ব নেই?"
"দায়িত্ব মানেই কি জোর করে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দুটো মানুষের একে অপরের সাথে বেঁধে রাখা?"
"দেখ, বাবা মা হলে আমরা ছেলে মেয়েদের জন্য এমন অনেক কিছু ভালো না লাগলেও করি। আমাদের বাচ্চাদের ভালোর জন্যই এই কাজ করতে হয় আমাদের"
"তাই বলে দ্বিতীয় বিয়েও? অনেকেই এখন আমাকে বলতেছে কেন তরীকে বিয়ে করতেছি। আমার তো আগে বিয়ে হয় নি"
"তাতে কি? আমাদের বউ কি খারাপ? বাচ্চা হলেই মেয়েরা শেষ হয়ে যায়?!"
ওপাশে জিসানের মা খালেদা রেগে গেছেন। জিসান দ্রুত কন্ঠে বলল,
"আমি এসব কিচ্ছু বলিনি আম্মু! আমি বুঝাতে চাচ্ছিলাম, আমাকে বিয়ে দিতে চাইলে অন্য অনেক অপশন আছে, কিন্তু তাই বলে তরী কেন? ওকেও বা কেন জোর করতেছ?"
"কারণ ইশতি তোকে আব্বু ডাকে! তরী আজকে না হোক, কালকে তো বিয়ে করবে, নাকি? দুইটা বাচ্চাকে একা মানুষ করা এত সহজ? ওর বাবার এত টাকা আছে? ওর নিজেও তো কোনো চাকরি করে না। আজকালকার জীবনে বাঁচা এত সহজ?"
"তো ও চাচার বাসায় থাকলেই হয়!"
"ঠিক আছে থাকলো। কিন্তু ইশতি যে তোকে আব্বু ডাকে, তার কি করবি?"
জিসানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। ফোন শক্ত হতে ধরে লাইন ডিসকানেক্ট করার আগে বলল,
"ওকে বলে দিব আমি ওর আব্বু না"
ফোন কাটার আগ মুহূর্তে ওর মায়ের কন্ঠে ভেসে এলো,
"তুই তো শুরুতে এরকম মানা করিস নাই! এখন কেন!"
জিসান ফোন কেটে সেটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ালো। খুব ক্ষুধা লেগেছে ওর৷ একে তো বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে, তার উপর গোসল করে এসেছে। ছোটবেলা থেকেই গোসলের পর একটা সাংঘাতিক ক্ষুধা লাগে ওর। আগে ভাবত, এটা ওর একার অভ্যেস। পরে জানতে পারল, গোসলের পর সবসময় খায় বলে ওর ব্রেইন এভাবেই স্টিমুলাস পায়।
খাওয়া শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পর ইশতি ওকে কল দিল৷ জিসাব একবার ভাবলো ফোন ধরবে না। কিন্তু ও জানে, ইশতির কেমন জেদ আছে। দেখা যাবে ফোন রিসিভ না করলে ছেলে মায়ের সাথে ঝামেলা করবে, বাসায় কান্নাকাটি জুড়ে দেবে। এমনিতেই তরী তন্দ্রা আর ইশতির খেয়াল রাখতে রাখতে ক্লান্ত হয়ে যায়, তার উপর অতিরিক্ত জেদ দেখালে আরও সমস্যা। জিসানের খুব মায়া লাগে, এত অল্পতে মেয়েটা কি কঠিন সময়ে আটকে গেল, যেন পানির নিচে কোনো পাথরে পা আটকে গেছে। না পারছে পানির উপর ওঠে নিঃশ্বাস নিতে, না পারছে পা আটকে পানির নিচে পড়ে থেকে জীবনের অন্ত ঘটাতে। জিসানের খুব ইচ্ছে হয়, বড় যত্ন করে তরীর হাত ধরে পানির উপর টেনে আনতে, ওকে আবার বেঁচে থাকার মত নিঃশ্বাস নিতে শেখাতে।
অথচ বাস্তবতা ভিন্ন! তরী হয়ত কখনোই স্বাভাবিক হবে না। ইমরানের স্মৃতি কখনোই মুছবে না, কারণ ইমরান আর ওর দুটো ভালোবাসার অস্তিত্ব তরীকে ঘিরে বিচরণ করছে। ওরা প্রতি মুহূর্তে ওদের মাকে মনে করিয়ে দিবে ওদের সত্যিকারের বাবার কথা। তরী চাইলেও পারবে না। জিসান সব বুঝে, তবুও ওর মায়া হয়, ভীষণ মায়া হয়। ও তরী আর ওর ভাইয়ের দুই সন্তানদের মায়া জালে আটকে গেছে, যে মায়া জাল না ও টিকিয়ে রাখতে পারছে, না পারছে না ছিন্ন করতে।
নিজেকে গভীর ভাবনা থেকে সরিয়ে রাখতে ইশতির কল রিসিভ করল। বাচ্চাটা সবসময় ওর মায়ের আইডি থেকে ভিডিও কল করে ওকে। জিসান ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। এই বাচ্চাটাই ওকে আরও বেশি মায়াজালে বেঁধে ফেলছে। আচ্ছা, ওর কি করা উচিত? সব ছিন্ন করে সরে যাওয়া? নাকি সবার সাথে তাল মিলিয়ে তরীর পাশে দাঁড়ানো? ও কি করে বোঝাবে ওর অনুভূতি গুলো? তরী ভাবছে, জিসান ওকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চায়। অথচ ও কেবল ওর ভাইয়ের সন্তানদের বাবা হওয়ার মর্যাদা চায়। অবচেতন মনে ও চায় না, ইশতি আর তন্দ্রা ওর কাছ থেকে সরে যাক। কিন্তু কি করবে ও? কি করা উচিত?
বাহিরে এখনো ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি পড়ছে। তরী আড়চোখে ছেলেকে দেখছে। আজ ফোন করার আগেও সে এই বলে বকেছে যে, জিসান ওর আব্বু না। ওর আব্বু পৃথিবীতে নেই। ইশতি সেটা শুনে জিসানকে কল করে বিচার চাইছে। ও কারো কথা মানতে নারাজ, ওর কাছে জিসানই ওর বাবা। ওদিকে তরীর শরীর হালকা গরম হয়ে আসছে। সত্যিই বুঝি জ্বর আসবে? আসলে আসুক, জ্বরের তাপের চাইতেও বেশি তাপমাত্রায় ওর জীবন ঝলসে যাচ্ছে। নিজের দিকে আর ওর তাকাতে ইচ্ছা করে না। আচ্ছা, বিয়ে করা ছাড়া আর কোনো সমাধান কি নেই?
চলবে...
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen2U.Pro