Màu nền
Font chữ
Font size
Chiều cao dòng

তরী আধশোয়া হয়ে তন্দ্রাকে দুধ খাওয়াচ্ছে। ছোট্ট মানুষটা দুধ খাচ্ছে আর মায়ের ওড়না এক হাতে ধরে খেলছে, কখনো সেটা দিয়ে নিজেকে ঢাকছে, কখনো আবার সরিয়ে দিচ্ছে। বয়সটা কম হলেও সে দুষ্টুমি শিখে গেছে বেশ। কি করে মাকে ব্যস্ত রাখতে হয়, তা এটুকু মানুষটা ঠিক বোঝে। তরী পেছনে একটা বালিশ টেনে শরীরের ভর সেখানে ছাড়লো। তন্দ্রাকে খাওয়ানোর সময় ওর শরীরে যেন সব ক্লান্তি ভর করে। আজকাল শরীর খুব দুর্বল লাগে। ঢুলুঢুলু চোখের পাতা লেগে আসতেই খাটের উপর এসে একটা বল পড়ে ওর ঘুম বরবাদ করে দিল। তরী লাল চোখ খুলে ছেলেকে দেখে একটা বকা দিল। বলা বাহুল্য, মায়ের কথায় তেমন একটা প্রভাব পড়ল না ছোট ইশতির উপর। সে বল নিয়ে অন্য ঘরে পালিয়ে গেল। তরী খেয়াল করল, তন্দ্রা ঘুমিয়ে পড়েছে। আলতো করে ওকে সরানোর সময় খেয়াল করল, খেয়া ঘরে ঢুকছে।

খেয়া তরীকে শুয়ে থাকতে দেখে বিছানার এক পাশে বসলো।
"ওভাবে ফুফুকে না বললে হতো না? সে এখন আম্মুর কাছে গিয়ে সিনক্রিয়েট করছে!"
তরীর নির্লিপ্ত উত্তর।
"আমি কি করব? সে অকারণে আমাকে এসব বাজে কথা শোনানোর কে?"
"তাই বলে মুখের উপর বলবা?"
"বলব না? উনার কথা শুনে মনে হচ্ছিল ইচ্ছা করে ইমরানকে মেরে ফেলেছি যেন আরেকটা বিয়ে করতে পারি! তুই কি এই স্টুপিড মহিলার পক্ষ হয়ে আমার সাথে কথা বলতে এসছিস?"
খেয়া একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
"নাহ, তা কেন? তুমি ভালো করে জানো আমিও তাকে সহ্য করতে পারি না। তবে তার মুখের উপর এসব বললে ঝামেলা না কমে আরও বেড়ে যায়। আর সেটা আব্বু আম্মুর উপর কেমন প্রভাব ফেলে তা তো জানোই"
"তার মানে আমি চুপ করে থাকব?"
"শুধু আব্বু আম্মুর খাতিরে"

তরী কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে নিল। মিনিট কয়েক পার হওয়ার পর খেয়া আবার মুখ খুললো।
"মাউইমা ফোন দিয়েছিল আজকে?"
"হু"
"আবার সেই আগের কথা?"
"আর কিই বা বলবে? নাতি নাতনীর খোঁজ নিয়েই শুরু করে সেই প্যাচাল। শুনতে আর ভালো লাগে না। আচ্ছা, আমি কি একা ওদের মানুষ করতে পারব না? পড়ালেখার কোনো সার্টিফিকেট কি আমার ঝুলিতে নেই? নাকি তাদের ধারণা বাচ্চা পালার জন্য আমার শরীর বিক্রি করে খেতে হবে?"
"ছিঃ আপু, কিসব বলো! এমন কেন হবে? মাউই কি এসব বলেছে?"
"বলেনি। কিন্তু সারাক্ষণ তো এই বলেই ঘ্যানঘ্যান করে, বাচ্চা একা কিভাবে মানুষ করবা, ওরা বাপ পাবে কই! তাই বলে কি এটাই সমাধান?"
"আমার কাছেও ব্যাপারটা একটু উইয়ার্ড লেগেছে"
"একটু লেগেছে? ব্যাপারটা তো আগাগোড়াই উইয়ার্ড! ভাসুরের সাথে আমার বিয়ের প্ল্যান কিভাবে করে তারা? হোক চাচাতো, কিন্তু আমার ভাসুর তো!"

খেয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
"কিন্তু উনাদের ম্যানেজ করবা কিভাবে?"

তরী জবাব দেয় না, গভীর চিন্তায় ডুব দিয়েছে সে।

কয়েকদিন পরের কথা। তরী একটা রেস্টুরেন্টে এসে ঢুকলো, পরনে ক্রিম রঙের ফুল স্লিভ থ্রিপিস আর বিরাট ওড়না দিয়ে পিন আপ করে হিজাব করেছে, সাথে তার এক পাশ টেনে শরীরও ঢেকে নিয়েছে। আগে মাঝে মাঝে সুন্দর সুন্দর থ্রিপিস কিছুটা বডি ফিটিং করে বানিয়ে পরলেও ইমরানের চলে যাওয়ার পর সে সব ঢোলা ঢালা কাপড় পরে। এরপরও যে তার জীবনে বিয়ে আসা থেমে নেই। দুই বাচ্চার মা হওয়ার পরও যখন ওর বিয়ের প্রস্তাব আসে, তখন ওর এই পুরুষ শাসিত সমাজটায় আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না।

তরী কাপড় অযথা টেনে নিজেকে আরও আড়াল করতে চায়, ওর চোখ আশেপাশে ঘুরছে। ঐ তো, ওখানে উনি বসে আছেন। তরীর নিঃশ্বাস আটকে আসতে চায়। ধীর পায়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল ও। সামনে অপেক্ষারত মানবের দৃষ্টি এখন তার উপর পড়েছে। তরীকে দেখে সে ভদ্রতা সূচক হাসি হাসলো। তরী হাসলো না, বরং ওর ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে উঠেছে। চেয়ারের দিকে সে ওকে বসতে ইশারা করলেও ও ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। শক্ত মুখে বলল,
"আপনি কি চান বলুন তো?"

সামনের মানুষটা হাত দিয়ে আবারও চেয়ার দেখালেন।
"না বসলে কি করে বলব? আমরা বসে কথা বলি প্লিজ? এখানে চল্লিশ মিনিট ধরে বসে আছি"
"তো আমি কি করব?"
"তুমি বসে কথা বললে আশা করা যায় আমাদের কথা দ্রুত শেষ হবে, তুমিও তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে পারবে। তন্দ্রাকে নিয়ে নিশ্চয়ই তোমার চিন্তা হচ্ছে"

তরী জবাব না দিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। জিসান হাতের মেন্যুকার্ড দেখিয়ে প্রশ্ন করলো,
"কি খাবে?"
"আমি এখানে খেতে আসিনি"
"কিছু অর্ডার না করলে অভদ্রতা দেখাবে"
"তাহলে আপনি অর্ডার করুন"
"আমি খাবো আর তুমি তাকিয়ে থাকবে?"
"আপনার পেট খারাপ হবে না, কথা দিচ্ছি"

জিসান হতাশ হয়ে ওয়েইটারকে ডেকে একটা ম্যাংগো মিল্কশেক অর্ডার করল। এতক্ষণ বসে থেকে মাত্র একটা মিল্কশেকের অর্ডার পেয়ে ওয়েটার বেশ হতাশ, বোঝাই যাচ্ছে। জিসান সেসব বাদ দিয়ে সামনে বসে থাকা তরীর দিকে মনোযোগ দিল। মেয়েটা নিজের নখ এমনভাবে দেখছে যেন তার নখের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু এই মুহূর্তে নেই। জিসান প্রশ্ন করল,
"আমি কি চাই সেটা বলার আগে বলো তুমি কি চাও?"

তরী ওর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। দুই হাত বুকের উপর বেঁধে বললো,
"আমি কি চাইবো তা তো আপনার না বোঝার কথা না। আমি যেভাবে আছি সেভাবেই বাঁচতে চাই"
"তন্দ্রা আর ইশতির কি হবে?"
"কি আবার হবে? ওদের মা বেঁচে থাকতে ওরা ওদের মায়ের সাথেই থাকবে!"
"কিন্তু এভাবে থাকলে তোমাকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে যে?"
"আর রাজী হলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?"

জিসান গাল চুলকে নিল।
"তা না। জীবন মানেই তো সমস্যা। তবে তোমার সেসব সমস্যার মোকাবিলা আর সমাধান করতে সুবিধা হবে"
"আপনারা কেন বুঝতে পারছেন না যে আমি পারব না? পারব না মানে না! না মানে হ্যাঁ কখনোই না! কেন আপনারা সবাই প্রেশার কুকারের মত চারদিক থেকে চাপ সৃষ্টি করছেন?"

তরীর কন্ঠে তীব্র অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। সে চামচ নাড়তে নড়তে বলল,
"সবাই মিলে আমাকে রাজী হতে বলছেন আবার বিয়ে করার জন্য। কতদিন হলো ইমরান মারা গেছে? দশ মাস মাত্র! এর মাঝে আমি কিভাবে বিয়ে করব আবার? তাও আবার আপনাকে?!"

জিসানের দিকে তরী তাকিয়ে আছে। ইমরান আর ও খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেছিল আর ছেলে মেয়ে নিতেও বেশি সময় নেয়নি। তরীরা মধ্য মধ্যবিত্ত পর্যায়ের পরিবার। তখন ইমরানের মোটামুটি গোছের চাকরি আর সম্পদশালী পরিবারের কাছে তাদের পছন্দমতো আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে মেয়েকে তুলে দিয়েছিলেন। সব তো ভালোই চলছিল, কিন্তু ইমরান চলে গিয়ে তরীকে বিপদে ফেলে দিল। এত দ্রুত অবশ্য ওকে বিয়ে করতে কেউ চাপ দিত না, সমস্যা বাঁধলো দু মাস আগে।

পারিবারিক একটা অনুষ্ঠানে তরী তন্দ্রা আর ইশতিকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি হাজির হয়। অনেক দিন পর সে শ্বশুর বাড়িতে সিলেট গেছে। মূলত বাচ্চাদের নিয়ে ওদের দাদা বাড়িতে সময় কাটাতেই আসা, বোনাস হিসেবে একটা অনুষ্ঠান পেয়ে গেল। ইমরান চলে যাবার পর থেকে তরী মন মরা হয়ে থাকে বলে সবাই জোর করে ওকে শাড়ি পরিয়ে নিয়ে যায়। ওর চাচী শ্বাশুড়ির বাড়িতে সবাইকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। না, কোনো উপলক্ষ হিসেবে না, অনেক দিন ভাই বোনেরা এক হয় না, তাই। ইশতি ওর দুই ফুপিকে পেয়ে আনন্দে দিশেহারা হয়ে এদিকে ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে, সাথে ওর ভাই বোনরাও আছে। সবাই খেয়াল রাখছে বলে তরী মেয়েকে একটা স্ট্রলারে শুইয়ে রেখে মাঝে মাঝে নাড়ছে। এত শব্দের মাঝে তন্দ্রা ঘুমুচ্ছে না, তবে খুব বেশি যন্ত্রণাও দিচ্ছে না। সে কৌতূহল নিয়ে আশেপাশে দেখছে। তরীর কাছে অনেকেই আসছে, আবার তরী নিজেও এ ঘরে ও ঘরে গিয়ে কথাবার্তা বলছে।

দুপুরের খাবারের পর্ব শেষে সবাইকে তরীর ননাস জুঁই বসার ঘরে ডেকে আনলো। বিশাল ঘরটায় কিছুক্ষণের মাঝে ভরে উঠেছে। ইকরা, তরীর ননদ ইশতিকে খুঁজে নিয়ে আসলো জোর করে। ইশতি কিছুতেই আসতে চাচ্ছিল না, আর সেটা জানাতে ইকরা ওর কাছে আসে। তরী ছেলেকে মার দিয়ে নিয়ে আসবে, এমন মনোভাব নিয়ে রওনা দেয়ার আগেই দেখল, জিসান ইশতিকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকছে। ইশতি সবার সামনে জিসানের দু গাল ধরে  তখন জোরে জোরে বলল,
"তুমি দেখতে আমার আব্বুর মত। তুমি আমাকে আব্বুর মত আদর কর। আমি এখন থেকে তোমাকে আব্বু ডাকব!"

অবুঝ শিশুর কিছু অবুঝ নিষ্পাপ বুলি শোনে সবার যেন চোখ খুলে গেল। সবাই জিসান আর তরীকে দেখছে। এই সমাধানের কথা তো ঘুণাক্ষরেও কারো মাথায় আসেনি! জিসান বয়সে ইমরানের থেকে কয়েক বছরের বড় হলেও সে এখনো বিয়ে করেনি। তাই এইতো সুযোগ! ওদের এক করে দিলে তরীও এই ঘরের বউ হয়েই থাকবে, বাচ্চারাও তাদের বাবা পাবে! জিসানদের বাড়ির বসার ঘর থেকে সেই গুঞ্জন শুরু হয়ে আজ সবাই রীতিমতো চাপ সৃষ্টি করছে ওদের দুজনের উপর।

তরীকে বাস্তবে টেনে আনতে জিসান হালকা কাশি দিল। তরীর দিকে ফিরে বলল,
"দেখো, আমিও চাই না তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু হোক। বিয়ে মানে তো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, এক পাক্ষিক না। তবুও তুমি ওদের কথা ভেবেও তো এগিয়ে দেখতে পারো? প্রায় প্রতিদিন ইশতি আমার সাথে কথা বলে, ভিডিও কল দেয়। অন্তত ওদের খাতিরে ভেবে দেখো?"
"আর আমার কি হবে? আমি ইমরানকে ভুলে গেছি? আমি পারব আপনাকে স্বামীর মর্যাদা দিতে? সম্ভব এটা?! আর মানুষই বা কি বলবে? এর মাঝে কত আজেবাজে কথাও শুনছি আমি! আমার স্ট্রাগল নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা আছে আপনার?!"
"আমি জানি তোমার সমস্যা গুলো। কিন্তু... "
"প্লিজ, সরাসরি বলুন আপনি কি চান?"

জিসান চুপ করে টেবিলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। তরী তীক্ষ্ণ চোখে জিসানকে দেখছে। কেন যেন ওর মনে হচ্ছে, এই গুঞ্জনকে সেদিন পারিবারিক সিদ্ধান্তে পরিণত করার পেছনে সবচেয়ে বড় হাত জিসানের নিজেই। সেই তার ভাইয়ের বউকে বিয়ে করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জিসান আর ওর মায়ের কার‍ণে এখন সবাই মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তরীর সবচেয়ে বেশি রাগ কাজ করে সামনে বসে থাকা মানুষটার উপর। এর সমস্যা কি আসলে? ভাইয়ের বউকে কিভাবে একটা মানুষ বিয়ে করতে রাজী হতে পারে?! হতে পারে ও এখনো যথেষ্ট সুন্দরী এবং নিজের ফিগার ধরে রেখেছে। কিন্তু এর মানে কি...!

জিসান তরীকে গম্ভীর মুখে জানালো,
"আমি বিয়েটা করতে চাই। আমাদের জন্য না, আমার ভাইয়ের বাচ্চাদের জন্য। ওদের দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়, নিজের ছোট বেলার কথা মনে পড়ে যায়। আব্বা মারা যাওয়ার পর চাচাই আমাদের সব দায়িত্ব পালন করেন। আমি চাই না আমার ভাইয়ের এতীম বাচ্চারা বাবার আদর ছাড়া বড় হোক"

তরীর চোখ ফেটে কান্না আসছে। এতক্ষণ অনেক কষ্টে নিজের আবেগটুকু আটকে রেখেছিল, অবাধ্য পানির ঢলের ন্যায় তা ওর সমস্ত শরীরে বিস্ফোরণ করায়।

"প্লিজ! আমাকে মাফ করেন আপনারা! আমি আর পারছি না আপনাদের এসব সহ্য করতে! আমাকে আর আমার বাচ্চাদের নিয়ে কারো কিছু ভাবার দরকার নেই! আমাকে মুক্তি দিন আপনারা! জাস্ট মুক্তি দিন!"

চিৎকার করে কেঁদে শব্দগুলো বলেই তরী ব্যাগ নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে জিসানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। বাইরে বেরিয়ে তরী দেখলো, কেবল সে নয়, তার সাথে আকাশটাও কাঁদছে। তরী ধরনীর বুকে আষাঢ়ের আছড়ে পড়া প্রবল বর্ষণের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে দিল। বর্ষণের পানি থেকে নিজেকে বাঁচানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে কাছের একটা রিকশাতে উঠে পড়ল। ওর সমস্ত শরীরে যেন কেউ পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আজ বৃষ্টির শীতল জলে সেই যন্ত্রণা লাঘব করতে চায়!

চলবে...

Bạn đang đọc truyện trên: Truyen2U.Pro