#আমি_যাদুকর
লেখা #AbiarMaria
৩
আজমেরী হোসেন আর তাহের দুজনেই বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে। তিন্নির খারাপ কিছু হয়ে যায় নি তো? তিন্নি কেঁপে কেঁপে উঠে মায়ের কাছে পানি চাইলো। তাহের দৌড়ে বোনের জন্য পানি নিয়ে এসেছে। বোনের মাথায় হাত রেখে বলল,
"আপু, কি হয়েছে তোমার?"
তিন্নি পানি খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে। সে মা আর ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে বুঝলো, এতটা রিএকশন করা ঠিক হয়নি। মাথা নেড়ে নিজেকে খানিকটা স্বাভাবিক করে বলল,
"তেমন কিছু না ভাই। তুই পড়"
আজমেরী হোসেন দুশ্চিন্তা নিয়ে বললেন,
"এভাবে দৌড়ে আসলি যে? কোনো বিপদ?"
তিন্নি হাত নেড়ে বলল,
"অন্ধকার হয়ে গেছে তো, কি দেখতে কি দেখলাম। তেমন কিছু না আম্মু"
"লুকাস না মা। বল, কি দেখে এত ভয় পেলি?"
"কিছু না আম্মু, কিছু না"
তিন্নি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে, যদিও মাথায় কিছুক্ষণ আগের হওয়া ঘটনা ঘুরছে। সে স্বাভাবিকভাবে বাকি সময়টুকু কাটানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চালালো।
রাতে ঘুমাবার সময় যখন ঘুম প্রায় দুচোখ জুড়ে তার রাজত্ব করতে শুরু করেছে, ঠিক তখন তিন্নির মানসপটে সেই মানুষের অবয়ব ভেসে উঠলো। এই মানুষটি তো সেই বাসের ছেলেটাই, যে ওকে সেদিন বাঁচিয়েছিল, এখন আরও একবার ওকে বখাটেদের হাত থেকে বাঁচালো। সে তো তবে কোনো জ্বীন ভূত হতে পারে না। তাহলে? ওকে কি ছেলেটা ফলো করছে? কিন্তু কেন? রূপে গুণে সে যতই অসামান্য হোক, তার কাছে এই ছেলে এমন কি চাইতে পারে? অবশ্য তিন্নির বাবা বেঁচে থাকলে আলাদা হিসেব ছিল। তিন্নির বাবা কাজ করতেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মারা যাবার পর আজমেরী হোসেন পেনশনের টাকা তুলে আনেন। সেই কিছু চলে যায়, কিছু তার মামা দেয়। আর টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করে তিন্নি আর তাহেরের খরচ চলে। এভাবেই চলছে, সংযম আর অভাবের মাঝে বেঁচে থেকে। এমতাবস্থায় তিন্নির জন্য কেন কেউ কিছু করবে? কোথায়, কখনো তো কেউ ওর জন্য এগিয়ে এসে কিছু করেনি! এই যে ভরা যৌবনে সে পা রাখলো, অথচ শৈশব কৈশোরে তেমন কোনো বন্ধুও জোটেনি। যারা ছিল, তারা দুধের মাছি, কিংবা ছোট্ট জীবনে সামান্য সময়ের জন্য এসেছিল।
স্কুল কলেজে তিন্নি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। গার্লস স্কাউটে প্রথম থেকেই নাম ছিল। ভলেন্টিয়ার হিসেবেও কাজ করেছে।ক্লাসে প্রথম সারির ছাত্রী ছিল সে। কলেজের কিছু অনুষ্ঠানে উপস্থাপনাও করেছে। একাডেমিক জীবনে যে মেয়েটা এত স্বতঃস্ফূর্ত, তার আশেপাশে অনেকে ঘেঁষলেও কেউ তার সাথে থাকেনি। বান্ধবী যাই দু'একজন হয়েছিল, তারা অন্যান্য বড় বড় জেলা শহরে চলে গেছে। মফস্বলে কি আর উচ্চশিক্ষা কিংবা ভালো সুযোগ আছে?
তিন্নি বুকে হাত চেপে ধরে রাখে। আলো আঁধারির খেলায় আজও সেই আগন্তুকের চেহারা চিনতে পারেনি। তবে কন্ঠ চিনে রেখেছে। ভরাট পুরুষালো কন্ঠস্বর তার কানে এখনো বাজছে। তিন্নি বুঝে উঠতে পারছে না, তাদের দুজনের বারবার দেখা হওয়াটা কি ভাগ্যের খেলা? নাকি কেবলই কাকতালীয় বিষয়?
পরদিন যখন তিন্নি বের হবে, আজমেরী হোসেন তখন মেয়েকে টেনে ধরলেন। বিড়বিড় করে কি যেন একটা চোখ বুঁজে পড়লেন। তিন্নি মাকে পরীক্ষা ছাড়া এমন করে দুয়া পড়তে দেখেনি। দুয়াই তো পড়ছে বোধহয়। মেয়ের জন্য নিশ্চয়ই মায়ের মন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আছে! তিন্নি চোখের কোণে এক ফোঁটা জল জমলো। এ জল দুঃখের নয়, এ জল ভালোবাসার, এ জল আনন্দের, এ জল মায়ের ছায়ার শীতলতায় বাস করতে পারার কারণে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতার। তিন্নির যখনই বাবার চলে যাবার কথা মনে পড়ে, সাথে সাথে মায়ের বেঁচে থাকার কথাও মনে পড়ে। আল্লাহ হয়ত ওকে বাবাহারা করেছেন, কিন্তু মা হারা তো করেননি! তিন্নি চোখ ভরে মাকে দেখে। কি অসীম মমতায় দুটো বাচ্চাকে তিনি বুক পেতে আগলে রেখেছেন যেখানে বাচ্চা দুটির জন্য পুরো পৃথিবীর মমতার ভাণ্ডার প্রায় শূন্য! সে আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞ, কেউ না থাকলেও তার মা আর ভাই তো আছে। সবচেয়ে বড় কথা, বাবা না থাকলেও বাবার দুয়া, আশীর্বাদ তাকে সবসময় ঘিরে রেখেছে- এমন একটা অনুভূতি প্রায়ই তাকে দোলা দিয়ে যায়।
তিন্নি আজ রাস্তায় বেরিয়েও আশপাশ ভালো করে দেখে নেয়। কেউ কি ওকে ফলো করছে? নাহ, কেউ নেই। তবুও সে পুরোটা সময় সতর্ক থাকলো। ঘর থেকে বেরিয়ে টিউশন এ যাওয়া থেকে ঘরে ফেরা পর্যন্ত নিজের সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ রাখলো। আপ্রাণ চেষ্টা করলো, ঐ আগন্তুককে চোখে পড়ে কিনা, সে খেয়াল করার। অথচ কাউকে পেলো না।
এমন করে আবারও সপ্তাহ খানেক পেরিয়ে গেছে। তিন্নি পুরো সপ্তাহ ধরে চেষ্টা করে গেছে মানুষটাকে খোঁজার। বৃথা চেষ্টা। পুরো একটা সপ্তাহ খানিকটা প্যারানয়েডের মতো দম বন্ধ করে কাটিয়েছে। ঘর থেকে বেরুলেই খুঁজতে শুরু করতো তাকে। অথচ একবার ভুল করেও তাকে চোখে পড়লো না।
তিন্নি নিজেকে বোঝাতে শুরু করলো। পর পর দুটো ঘটনা নিশ্চয়ই এবং অবশ্যম্ভাবী ভাবেই কাকতালীয়; এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। পৃথিবীতে কোনো পুরুষের অতটা দায় পড়েনি তার পেছন পেছন ঘুরবে, তাকে আগলে রাখবে, তার জন্য বুক পেতে খুন হবে কিংবা করবে। এত ভাগ্য নিয়ে ওর জন্ম হয়নি- এত দিনে এই বিশ্বাসটুকু পাকাপোক্ত হয়েছে। তাই সে পুরো বিষয়টি মাথা থেকে এক পাশে সরিয়ে রাখার চেষ্টা চালালো। ধীরে ধীরে সে এই বিষয়ে সফলও হলো।
এদিকে আজমল হোসেনের দোকানে এসে বসে আছে শামসুদ্দীন খান। তার বড় ছেলের জন্য একজন সুযোগ্য অল্প বয়সী মোটামুটি সুন্দরী পাত্রী খুঁজছে যার উপরে নির্ভর করবে তার বড় ছেলের ভবিষ্যৎ। আজমল হোসেনের বাজারে মোটামুটি বিশাল চালের আড়ৎ। তার অন্যতম দামী খদ্দের শামসুদ্দীন খান। শামসুদ্দীন খানের বাপ দাদার আমল থেকে বিশাল জমিদারী। শোনা যায়, একাত্তরের যুদ্ধের সময়ও তাদের সম্পদ লুটপাট হয়নি, বরং আরও বেড়েছে। সেই বেড়ে ওঠার পেছনে বেশ কানাঘুষা চলে, গুঞ্জন ভেসে ওঠে। তবু ক্ষমতার আড়ালে চাপা পড়ে যায় সব। সমাজের সাধারণ মানুষ গুলোর চোখে সবসময় বাহ্যিক চাকচিক্য আর ক্ষমতার দাপট চোখে পড়ে। এর পেছনের লুকানো নোংরা ইতিহাস নিয়ে তারা মাথা ঘামাতে চায় না। দেখা অর্থ সম্পদের ছড়াছড়ি, সেখানে আর সব হিসেব নিকেশ নস্যি। শোনা যায়, খান সাহেবের ঠিকাদারি ব্যবসা আছে। অনেক বড় বড় দালানের প্রজেক্ট থেকে তাদের মাসিক অর্থ আসে। এসব যদি সত্যি নাও হয়, তাতেও মানুষের আসে যায় না। খান সাহেবরা এলাকার সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ, এটাই মুখ্য।
শামসুদ্দীন খান কখনো নিজে এসে বাজার থেকে মাল কেনেন না, বরং লোক পাঠিয়ে দেন। দোকানের মালিকেরা শোনামাত্রই চাহিদামতো সবকিছু বাড়তে নিজ খরচে পৌঁছে দেন। অথচ আজ সেই মহামান্য ব্যক্তিটি আজমল হোসেনের দোকানে এসে বসে আছেন। কি সৌভাগ্য, কি সৌভাগ্য!
আজমল হোসেন তার খাতিরযত্নের কোনো কমতি রাখেনি। বাজারের সবচেয়ে ভালো দোকান থেকে পেঁয়াজু, আলুর চপ, শিঙারা, মোগলাই, মিষ্টি, ঠান্ডা পানীয় এনে তার সামনে রেখেছে। শামসুদ্দীন খানের অবশ্য খাবারের দিকে কোনো খেয়াল নেই। তিনি হাতে একটা ভারী ছড়ি নিয়ে চেয়ারে বসে আছেন। তার সাথে আরও তিনজন আছে, যারা দাঁড়িয়ে আছে। তার সফেদ শুভ্র পায়জামা পাঞ্জাবিতে কোনো দাগ নেই। তার সাথে বাকিদের মুখ খানাও গম্ভীর। আজমল হোসেন খুঁজে পান না, বাকি তিন জন খান সাহেবের সাথে কেন আসলেন। তারা কি দেহরক্ষী? নাকি কাজের লোক? আজমল হোসেন সামনে বসা খান সাহেবের দিকে তেলতেলে দৃষ্টিতে হাত কচলাতে কচলাতে বলেন,
"স্যার, কি জন্য আসলেন, বললেন না তো। কিছু একটা মুখে দেন? আমরা নাইলে খাইতে খাইতে কথা বলি?"
খান সাহেব সোজাসুজি আজমল হোসেনের মুখের দিকে তাকান। বেশ সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে তিনি বলেন,
"তুমি তো জানো, আমার বড় ছেলে রায়হান খানের জন্য মেয়ে দেখতেছি। তাই না?"
আজমল হোসেন মুখের হাসিতে আরেকটু তেল ঢেলে সেটাকে কান পর্যন্ত টেনে আনলেন। হেসে হেসে বললেন,
"জ্বী স্যার, কানে এসেছে তো। তা, মেয়ে কি পেয়েছেন?"
খান সাহেব ছড়িতে হাত রেখে এবার কিছুটা গম্ভীর হোন।
"নাহ, এখনো তেমন মেয়ে মিলেনি"
আজমল হোসেন কি বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না। তিনি খান সাহেবের মুখ পানে চেয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন, এরপর তিনি কি বলবেন তা শোনার জন্য। খান সাহেব কিছুটা থেমে বললেন,
"কিছুদিন আগে রাস্তায় একটা মেয়েকে দেখলাম। সুন্দরই। কম বয়সী। ভদ্র ঘরেরই মনে হইলো। মেয়েটারে আমার বেশ মনে ধরলো। খোঁজ নিলাম। আমি ভুল করি নাই, মেয়ের পরিবার ভালোই"
আজমল হোসেন এবার কিছু বলার মতো খুঁজে পান।
"স্যার, আপনি প্রস্তাব দিছিলেন? নাকি আমি মেয়ের পরিবারের সাথে কথা বলমু? হ্যারা আপনের কথা শুনলে রাজী না হইয়া পারবোই না। আপনের পছন্দ হইছে ঐ মেয়েরে, এ তো ঐ মেয়ের সাত পুরুষের সৌভাগ্য!"
খান সাহেব মাথা নাড়েন। তিনি বেশ দৃঢ়তার সাথে বললেন,
"মেয়ের পরিবারের সাথে এখনো এই নিয়া কথা বলি নাই। তবে বলতে চাই। এইজন্যই আজকে বাজারে আসা"
আজমল আগ্রহ ভরে প্রশ্ন করলেন,
"কার মেয়ে স্যার?"
খান সাহেব বললেন,
"তোমার বোনের মেয়ে। আমার খুব পছন্দ হইছে বড় ছেলের জন্য। আশা করি আপত্তি করবা না তোমরা, নাকি?"
আজমল হোসেন চমকে ওঠেন। তিন্নির জন্য এত বড় ঘর থেকে প্রস্তাব আসলো? এও সম্ভব?! কখনো ভেবেছিল খান সাহেবদের মত এত বড় পরিবারে ওরা আত্মীয়তার সুযোগ পাবে? সমাজের এলিট শ্রেণীর মানুষ খান সাহেবেরা। তাদের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করা মানেই যেন অনেকের জন্ম সার্থক হওয়া। সেখানে ওরা আত্মীয় হবে?! কি করে এত সৌভাগ্য তার কাছে এসে ধরা দিল?
বিস্ময় এবং আনন্দ তার মুখে একত্রে খেলা করে। এই সুযোগ কোনোভাবেই ছাড়া যাবে না। অথচ দুদিন আগেও ভাগ্নী তার কাছে পড়াশোনা করার জন্য যে মিনতি করেছে, তার সাহায্য কামনা করেছে, সে কথা সে বেমালুম ভুলে গেছে। এত বড় মানুষদের সাথে আত্মীয়তা করার চেয়ে পড়াশোনা কখনো গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না!
চলবে...
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen2U.Pro