এরচেয়ে বেশিকিছু, অতঃপর...
#৩
যা বলছিলাম।বন্ধুত্ব হওয়ার কিছুদিনের মাঝেই আমাদের বন্ধুত্ব অন্য পর্যায়ে চলে গেল,যাকে বলে পেটে পেটে পিরিতি!আমরা একত্রে বসতাম,একত্রে ঘুরতাম আর প্রচুর মারামারি করতাম! মারামারিতে কেউই পিছিয়ে থাকতাম না।
একদিন ও আমাকে নিয়ে কফি হাইজে যায়।আমি তখনো জানি না কফির টেস্ট কেমন।এক কাপ হট কফি খেয়ে আমার মনে হল এ যেন অমৃত! এত মজার জিনিস আমি না খেয়ে এতদিন বাঁচলাম কেমন করে?এমনিই সেখানকার কফিটা বিখ্যাত ছিল,তার উপর এই কফি!
আমি আর সিয়াম যে কত যে কফি খেয়েছি,কত স্মৃতি যে এই কফিতে জড়ানো, আমার কত অভিমান যে এই কফিতে ভেঙেছে তার ইয়ত্তা নেই।
খালি মগটা টেবিলের একপাশে রেখে দিলাম।বাঁহাত দিয়ে থাই গ্লাসটা খুলে বেলকনিতে পা রাখলাম।১২তলা বিল্ডিং থেকে নিচের দিকে শহর আর আকাশ দেখার ভাগ্য এ শহরে খুব বেশি মানুষের হয় না,আমার হয়েছে,আর তা কেবল রাইয়ানের জন্য। রাইয়ান,আমার স্বামী।ওর অফিসেই এখন আমি ওর সাথে আছি,ওর অবর্তমানে দেশে আমাকেই সব দেখতে হয়।শো শো বাতাসে আমার ওড়না উড়তে লাগল,আরেকটু হলে মনে হয় মেঘগুলোও আমাকে ছুঁয়ে দিত।আমি চোখ বুজে বৃষ্টির দিনের কথা ভাবি।৩৮ বছরে কত কিই না ঘটে গেল! এই রাইয়ান শুধুই আমার স্বামী,ওর সাথে অফিসে জয়েনের আগে কখনো দেখা হয়নি।তার আগে আমার সর্বস্ব জুড়ে ছিল আহাদ...
হ্যাঁ,আহাদ,আমার ভার্সিটি লাইফের ক্রাশ।ওকে প্রথম দেখি এই বৃষ্টির দিনেই।আমাদের ক্যাম্পাসের গিটার বাজাচ্ছিল।আমি খুব পাগল ছিলাম গিটারের।সিয়ামে অসভ্যটাকে কত বললাম ওর কোন বন্ধুকে যেন বলে আমায় গিটার শেখাতে,কিন্তু না!সেদিন আহাদের গিটারের সুরে মনে হচ্ছিল আনন্দে মূর্ছা যাব!সিয়াম আমার অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছিল।বাসায় ফেরার সময় সেদিন সিয়াম আমাকে খোঁচা মেরে বলল,
-প্রেমে পড়ে গেলি নাকি?
আমি ওর পিঠে ধুমধাম দুটো দিয়ে বললাম,
-তোকে কত বললাম হারামী আমাকে গিটার শিখানোর ব্যবস্থা করে দে,তা না!আরেকজন যেই না গীটার বাজাচ্ছিল আর আমি শুনছিলাম,ওমনি টিটকারি?!
ও হাসি দিয়ে আমার মার ঠেকাতে ঠেকাতে বলল,
-আজ গীটার,কাল গীটারিস্ট,এভাবেই তো ধাপে ধাপে প্রেমে পড়ে মানুষ!
আমি ওর পিঠে আবার ধুমধাম বসালাম।ও তো হেসেই খুন!
তারপর মাথা ডলতে ডলতে আমার দিকে চেয়ে ভেটকি মেরে বলল,
-ওর নাম জানিস?
আমি চোখ দুটো বড় বড় করে একবার ওর দিকে চাইলাম,আরেকবার সামনের দিকে,আবার ওর দিকে আবার সামনের দিকে আবার ওর দিকে,এরপর বল্লাম,
-তুই জানিস?!
ও পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে বলল,
-আহাদ নাম ওর,এবার এম.বি.এ করছে।দেখতে যেমন স্মার্ট,চরিত্রও মারাত্মক রকম ভালো,একটা ছোট এতিমখানা চালায় এ বয়সেই,উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে,তিন ভাই বোন,কথাবার্তায়ও মাশাআল্লাহ!
আমি অবাক হয়ে ভাবতে থাকি,এত পারফেক্ট ছেলে কি দুনিয়াতে আছে?!থাকতে পারে?! ভার্সিটির আরো ২০টা মেয়ের মত আমিও ওকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিলাম।কিন্তু সিয়ামকে তো এসব টের পেতে দেয়া যাবে না।তাই আমি ওকে মারতে মারতেই ফিরে গেলাম সেদিনের মত বাসায়।
কিছুদিন পর আবার আহাদকে দেখলাম ক্যাম্পাসে।সেদিন ও গান গাচ্ছিল।মনে হচ্ছিল সিয়াম হারামীর কথাই সত্যি হবে।সেদিন ওর গানের প্রেমে পড়ে গেলাম।কিছু কিছু ছেলে এত্ত সুন্দর করে কেমন করে যে গান করে!আমি আবারো বুকে বই খাতা চেপে ধরে গাড় বাঁকিয়ে ওর গান শুনতে থাকি।আহাদের গান শেষ হতেই আমার মোহ ভাঙে,আমি দ্রুত পায়ে প্রস্থান করি।
আমি বাংলা ব্যান্ডের গান তেমন শুনতাম না বললেই চলে,কিন্তু আস্তে আস্তে শুধু আহাদের পছন্দ আর তার কন্ঠস্বরের কারণেই শুনতে শুরু করি।বাচ্চুদা,জেমস,শাফিন-রাফিন,এদের গান আমার প্রিয় হয়ে উঠল।গুন গুন করে দিনে রাতে এসব গান গাইতাম আর দুই আঙুলে চুল পেঁচাতাম। প্রায়শই বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে এমন করতাম আর আনমনেই ওর কথা ভাবতাম।স্কুল গেল,কলেজ গেল,ভার্সিটির দু বছরও গেল,কাউকে নিয়ে তো এতটা ভাবি নি!তবে আহাদকে নিয়ে এত ভাবছি কেন?
স্কুল কলেজ কিংবা ভার্সিটি, কোন ধাপেই প্রেম-টেম নিয়ে এংগেজ হওয়ার মত বাজে কাজ আমার দ্বারা হয়নি।তার দুটো কারণ ছিল।প্রথমত, আমি একটি রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে,আমার বাবা সবার সাথে এমনকি রিক্সাওয়ালার সাথে বিয়ে দিতেও রাজী,কিন্তু যদি প্রেম করি,তার সাথে দিবে না!এ কেমন বিচার জানি না,কিন্তু এটাই বিচার!
আর দ্বিতীয়ত,সিয়াম। হ্যাঁ,সিয়াম!ও আর আমি স্কুল থেকে শুরু করে ভার্সিটি পর্যন্ত চুইংগামের মত লেগে থাকতাম।তাছাড়া আমাদের কাজ ছিল দুরকমঃ এক,পড়ালেখা করা,
দুই,জীবনের সব বুদ্ধি খাটিয়ে দুষ্টুমি করা।
খুব কম দিনই আমরা দুষ্টামি ছাড়া কাটিয়েছি।আমাদের দুজনকে একসাথে হতেই দিত না আমাদের সার্কেল।আমরা একত্রে হওয়া মানেই বোম্ব ব্লাস্ট! আমরা একসাথে যুক্তি করে পড়তাম,আবার যুক্তি করে বাঁদরামিও করতাম।উদাহরণ দেই।
আমারা যখন কোথাও ঘুরতে যেতাম,আমাদের জ্বালায় আশেপাশে কোন কাপল থাকতে পারত না।ছোট বাচ্চার হাত থেকে আইস্ক্রিমও ছিনিয়ে নিয়ে খেয়ে ফেলেছি! কত গাছে উঠলাম! আমাকে সবাই ভদ্র শয়তান ডাকত।আমি এমনি বোরকা পড়ে ঘুরি,কিন্তু যখন এসব করার দরকার হত,বোরকা গুটিয়ে দুষ্টুমিতে নামতাম!
ক্লাসে কে কার সাথে প্রেম করছে,কে কাকে ডাবল ক্রস করছে,কে ছ্যাঁকা খেয়েছে,এসব খবর যেমন ছিল আমাদের নখদর্পণে,তেমন এদের নিয়ে কাউন্সিলিং বিচার আচারের কাজও আমরা দুই পন্ডিত মিলে করতাম।
আমার একটা বিখ্যাত জন্মদিনের ছবি আছে।এলবামটা আমার কাছেই।প্রথম ছবিতে আমি কেক কাটছি,দ্বিতীয় ছবিতে আমার মুখ সিয়াম চেপে ধরে রেখেছে কেকের মাঝে,তৃতীয় ছবিতে আমি সিয়ামের মুখ চেপে ধরেছি কেকের মাঝে,চতুর্থ ছবিতে দুজনই হা হা করে পেটে হাত দিয়ে হাসছি!
এই ছবিগুলো তুলে ধন্য করেছিল আমাদের প্রিয় বান্ধবী পুতুল। আজও সেদিনের ছবিগুলোয় হাত বুলাই,কি নিষ্পাপ সময় ছিল সেটা! যদিও আমরা মোটেও নিষ্পাপ বাচ্চা ছিলাম না এটাও নিশ্চিত!
দুষ্টুমিতে ডুবে থেকেও আমাদের পড়ালেখার ব্যাঘাত কখনো হয়নি,দুটোই সমানতালে চালাতাম দুজন মিলে।আমরা একই গ্রুপে ছিলাম,শুধু ভার্সিটিতে উঠে ও EEE আর আমি BBA তে চলে আসি।
আমাদের যেসব বন্ধু স্কুলের পর কলেজেও আমাদের সাথে পড়ত তারা সবাই আমাদের আগেপাছে সুযোগ পেলেই বলত,
-তোরা দুজন তো হিট প্রেমিক যুগল!
পিছে যারা বলত,তাদের ধরতে পারতাম না,কিন্তু সামনে যারা বলত তারা নির্ঘাত মার খেত!আমরা সবসময়ই বলতাম যে আমরা ভাই বোন,জানের জিগার দোস্ত,কিন্তু প্রেমে পড়েছি,এরকমটা কক্ষণো ভাবি নি,অনুভবও করিনি।কারণ আমরা দুজন দুজনের যায়গায় থেকে কোনোদিন এসব ভাবি নি,ও ও না,আর আমি তো প্রশ্নই আসে না।আমরা একজন অপরকে প্রচন্ড ভালোবাসতাম,এতে কোন সন্দেহ নেই,কিন্তু এটা ছিল বন্ধু হিসেবে,যাকে বলে বেস্ট ফ্রেন্ড! তবে আমি অনুভব করতাম,আমাদের বন্ধুত্বটা বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি ছিল।ভাই বোনও আলাদা হয়,বন্ধুত্বও ভাঙে, স্বামী স্ত্রীও একে অপরকে ছেড়ে চলে যায়।কিন্তু আমরা যদিও কখনো একে অপরকে "আমাকে কোনোদিন ছেড়ে যাবি না" "আমরা আজীবনে বন্ধু,কথা দে" "কখনো আলাদা হবো না" এরকম ন্যাকা ন্যাকা কথা দেইনি,তবুও আমরা দুজনই অনুভব করতাম যে আমরা কেউ কাউকে কখনো ছেড়ে যাব না।আমাদের দুজনের এমন দারুণ কেমিস্ট্রির জন্য অনেকে যেমন জেলাস ছিল,তেমন আমার আর সিয়ামের উপর ক্রাশ খাওয়া অনেক ছেলে মেয়েরাই আমাদের কাছে প্রেম নিবেদন করত না।এরা ভাবত,আমরা দুজনে যতই অস্বীকার করি,আমরা ডুবে ডুবে ঠিকি জল খাচ্ছি!
আমি সিয়ামের অনেক নোট করে দিয়েছি।ও যখনি ক্রিকেট বা বেডমিন্টন টুর্নামেন্ট খেলতে যেত,ওর পড়া আমি রেডি করে রাখতাম।আবার আমার যেদিন ক্লাস মিস যেত,ও আমার পড়া সংগ্রহ করে রাখত।ভার্সিটিতে এসে বিষয় আলাদা হয়ে গেলেও ও আমার জন্য আমার কোর্সমেটদের কাছ থেকে মেনেজ করে রাখত।কখনো বকা খেতে হলেও আমরা একত্রে খেতাম।একজনকে ক্লাস থেকে স্যার বের করে দিলে অন্যজনও বিনা বাক্যব্যয়ে বেরিয়ে আসত।সবাই ভাবত আমাদের প্রেম,কিন্তু আমরা দুজন বের হয়ে যেসব আকাম কুকাম করতাম,এগুলো বলতে গেলে কয়েক বছর ওম্নি চলে যাবে!
আমাদের প্রায়শই একটা কথা শুনতে হত, " আমাদের তো আর তোর মত সিয়াম নেই" বা "তোর মত রাইসা থাকলে আমিও নিশ্চিত হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতাম!"
To be Continued...
লেখনীতে, #AbiarMaria
Bạn đang đọc truyện trên: Truyen2U.Pro